বৈষ্ণব কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
১. অনন্ত
বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে ‘অনন্ত’ নামে অন্ততঃ দুজন কবি ছিলেন। দুজনেই ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের শিষ্য। একজন অনন্ত আচার্য। অন্যজন অনন্ত দাস। এঁদের মধ্যে অনন্ত দাসই শ্রেষ্ঠ। বাংলা ও ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই অনন্ত দাসের রচনা সুখপাঠ্য।
২. উদ্ধব দাস
উদ্ধবদাসের প্রকৃত নাম কৃষ্ণকান্ত মজুমদার। টেঙা বৈদ্যপুর তাঁর নিবাসস্থল। ইনি ছিলেন শ্রীনিবাস আচার্যের প্রপৌত্র রাধামোহন ঠাকুরের শিষ্য। তিনি ছিলেন পদকল্পতরুর সঙ্কলনকর্তা গোকুলানন্দ সেন বা বৈষ্ণবদাসের বন্ধু। বহু বিষয়ে বাংলা ও ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই তাঁর পদরচনায় তুল্য দক্ষতা ছিল।
৩. কবিশেখর
ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একজন পদকর্তা কবিশেখর, রায়শেখর, শেখর প্রভৃতি ভণিতা দিয়ে উৎকৃষ্ট পদ রচনা করেন। এঁর প্রকৃত নাম দৈবকীনন্দন সিংহ ; পিতার নাম চতুর্ভুজ ও মাতার নাম ইরাবতী। ইনি ছিলেন শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দনের শিষ্য। এঁর লেখা অন্যান্য গ্রন্থ — গোপাল বিজয়, গোপাল চরিত প্রভৃতি কাব্য এবং গোপীনাথ বিজয় নাটক।
৪. কবিরঞ্জন
শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দনের শিষ্য কবিরঞ্জন ব্রজবুলি ভাষায় বিদ্যাপতির অনুসরণে পদ রচনা করেন। এই কারণে এঁকে ‘ছোট বিদ্যাপতি’ বলে অভিহিত করা হয় (রসকল্পবল্লী—রামগোপাল দাস)। অনেকে উপরিউক্ত কবিশেখরকেও ‘ছোট বিদ্যাপতি’ বলেন।
৫. কবিবল্লভ
করতোয়া তীরবর্তী মহাস্থানের নিকট অরোড়া গ্রামে কবিবল্লভের জন্ম। পিতার নাম রাজবল্লভ। মাতার নাম বৈষ্ণবী। গদাধর পণ্ডিতের শাখাভুক্ত উদ্ধব দাস ছিলেন কবিবল্লভের গুরু। গোবিন্দদাস কবিরাজের একটি পদে ‘শ্রীবল্লভ’ বলে এঁর উল্লেখ আছে। ‘রসকদম্ব’ নামক বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত-গ্রন্থ এঁর রচনা।
৬. কানুরাম দাস
বৈষ্ণব পদাবলীতে একাধিক কানুরাম দাসের অস্তিত্ব বিদ্যামান। তাঁদের মধ্যে পদাবলীখ্যাত কানুরামদাস ছিলেন নিত্যানন্দ শাখাভুক্ত সদাশিব কবিরাজের পৌত্র এবং পদকর্তা পুরুষোত্তম দাসের পুত্র কানু ঠাকুর। যশোর জেলার পশ্চিমাংশে এঁর পাট। ইনি দ্বাদশ গোপালের অন্যতম। এছাড়া শ্রীখণ্ডবাসী রঘুনন্দন ঠাকুরের পুত্র ও জাহ্নবাদেবীর অনুচর এক কানুরাম, অদ্বৈতশিষ্য কানু পণ্ডিত এবং শ্যামানন্দশিষ্য রসিকানন্দের শিষ্য নীলাচলবাসী এক কানুদাস বিদ্যামান ছিলেন।
৭. কৃষ্ণদাস
উড়িষ্যার দণ্ডকেশ্বরের অন্তর্গত বাহাদুরপুর গ্রামে বাঙালি সদগোপকুলে কৃষ্ণদাসের জন্ম। পিতার নাম কৃষ্ণমণ্ডল, মাতার নাম দুরিকা। বহু সন্তানের মৃত্যুর পর কৃষ্ণদাসের জন্ম হওয়ার তার নাম হয় দুঃখী। অম্বিকা কালনায় নিত্যানন্দ-চৈতন্য মন্দিরের সেবকভক্ত হৃদয়চৈতন্য তাঁকে দীক্ষা দিয়ে নাম দেন কৃষ্ণদাস। বৃন্দাবনে জীব গোস্বামী তাঁর পাণ্ডিত্যে ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে শ্যামানন্দ নাম রাখেন। পরবর্তীকালে তিনি শ্রীনিবাস ও নরোত্তমের সঙ্গে মিলিতভাবে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে নিযুক্ত হন। প্রধানতঃ কৃষ্ণদাস নামে এবং শ্যামানন্দ নামেও বাংলা ও ব্রজবুলি ভাষায় তাঁর পদ আছে।
৮. কৃষ্ণদাস কবিরাজ
সুবিখ্যাত ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’র রচয়িতা কৃষ্ণদাস কবিরাজ (১৫২৭-১৬১৫) কাটোয়ার নিকটবর্তী নৈহাটী গ্রামের কাছাকাছি ঝামটপুরের নিবাসী ছিলেন। বলরামবেশী নিত্যানন্দের স্বপ্নদেশে কৃষ্ণদাস কৃন্দাবনে সনাতন-রূপ গোস্বামীর আশ্রয় নেন। রূপ গোস্বামীর তিরোধানের পর কৃষ্ণদাস রঘুনাথ দাসের আশ্রয়ে ছিলেন। বঙ্গভাষায় সুবিখ্যাত চৈতন্যচরিতামৃত কাব্য, সংস্কৃতে ‘গোবিন্দলীলামৃত’ মহাকাব্য ও ‘সারঙ্গরঙ্গদা’ টীকা রচনায় তিনি বিখ্যাত। পৃথকভাবে পদ রচনা না করলেও চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যে কবিরাজ গোস্বামীর উৎকৃষ্ট পদ রচনার নিদর্শন আছে।
৯. গোবিন্দ আচার্য
ঈশ্বরপুরীর শিষ্য বৃন্দাবনবাসী কাশীশ্বর গোস্বামীর মন্ত্রশিষ্য গোবিন্দ আচার্য বৃন্দাবনের শ্রীগোবিন্দ বিগ্রহের সেবাইত ছিলেন। তাঁর কিছু ভাল পদ আছে।
১০. গোবিন্দ ঘোষ
মুর্শিদাবাদের অধিবাসী বল্লভ ঘোষের অন্যতম পুত্র গোবিন্দ ঘোষ প্রথমে শ্রীগৌরাঙ্গের নবদ্বীপ লীলার পরিকর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হন এবং পরে নীলাচল লীলার সঙ্গী হন। এঁর অন্য দুই ভাই মাধব ঘোষ ও বাসুদেব ঘোষ। গোবিন্দের সমস্ত পদই গৌরাঙ্গ বিষয়ক। তিনি কীর্তন গানেও বিশেষ পারদর্শী।
১১. গোবিন্দদাস চক্রবর্তী
শ্রীনিবাস আচার্যের শিয্য। বোরাকুলি গ্রামে নিবাস।পত্নীর নাম সুচরিতা, পুত্রের নাম মাধবেন্দ্র। কবিত্ব ও কীর্তনে বিশেষতঃ ভক্তিতে দশা প্রাপ্তির জন্য তিনি ‘ভাবক চক্রবর্তী’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
১২. গোবিন্দদাস কবিরাজ
চৈতন্য তিরোধানের চারবছর পর ১৫৩৭ খ্রি. গোবিন্দদাস কবিরাজের জন্ম ; পিতা চৈতন্য-পরিকর চিরঞ্জীব। মাতার নাম সুনন্দা। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামচন্দ্র কবিরাজ। প্রথম জীবনে মাতামহ দামোদরের আশ্রয়ে শাক্ত পরিবেশে প্রতিপালিত হন। চল্লিশ বছর বয়সে শ্রীনিবাস আচার্যের কৃপায় ব্যাধিমুক্ত হয়ে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। গোবিন্দদাসের কবিত্বে তুষ্ট হয়ে জীব গোস্বামী ‘কবীন্দ্র’ উপাধি দেন। বহুসংখ্যক ভালো বৈষ্ণব পদ ছাড়াও ‘সঙ্গীত মাধব’ নাটক রচনা করেন। আনুমানিক ৭৬ বৎসর বয়সে ১৬১৩ খ্রি. আশ্বিন মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে গোবিন্দদাস তিরোহিত হন।
১৩. গোপাল দাস
১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে গোপাল দাস বা রামগোপাল দাস শ্রীখণ্ডের বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। রঘুনন্দনের বংশধর ও শিষ্য রতিপতি ছিলেন গোপালদাসের দীক্ষাগুরু। প্রথম বৈষ্ণব পদসংকলন ‘শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণরসকল্পবল্লী’ গোপাল দাসের সংকলন। এখানে গোপাল দাসের ভণিতায় কবির স্বরচিত পদ আছে। চণ্ডীদাসের কোন কোন বিখ্যাত পদ এই সঙ্কলনে গোপাল দাসের ভণিতায় পাওয়া যায়।
১৪. ঘনশ্যাম দাস
পদাবলী সাহিত্যে দুজন ঘনশ্যাম দাস। একজন গোবিন্দদাস কবিরাজের পৌত্র ঘনশ্যাম। ইনি সপ্তদশ শতকের। শ্রীনিবাস আচার্যের পুত্র গতিগোবিন্দের শিষ্য। সংস্কৃত ও ব্রজবুলিতে পদ রচনায় প্রশংসার যোগ্য। ‘গোবিন্দরতিমঞ্জরী’ নামে ইনি রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণির ভাষ্য রচনা করেন। অপর ঘনশ্যাম দাস হলেন অষ্টাদশ শতকের নরহরি চক্রবর্তী। ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থে ও ‘গীতচন্দ্রোদয়’ সংকলনে নরহরি ঘনশ্যাম দাস ভণিতায় স্বরচিত পদ অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
১৫. চণ্ডীদাস
চণ্ডীদাস নামে একাধিক কবি বর্তমান ছিলেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস এবং পদাবলীর চণ্ডীদাস দুজনেই ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং বাশুলী-উপাসক বলে উভয়েরই পরিচয় আছে। বাঁকুড়ার ছাতনা ও বীরভূমের নান্নুর গ্রাম এক এক চণ্ডীদাসকে নিজেদের বলে দাবী করে। চৈতন্যদেব কোন একজন চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন বলে জানা যায়। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ শ্রীচৈতন্যের নিকট মুকুন্দ কর্তৃক চণ্ডীদাসের যে পদটি উদ্ধৃত তা পদাবলীর চণ্ডীদাসের। রজকিনী রামীর সঙ্গে চণ্ডীদাসের প্রেমমূলক আখ্যান ও কিংবদন্তী বর্তমান।
১৬. চন্দ্রশেখর
অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধের বৈষ্ণব পদকর্তা। জন্মভূমি কাঁদড়া। পিতার নাম গোবিন্দানন্দ ঠাকুর। ভ্রাতা শশিশেখরও ছিলেন পদকর্তা। দুজনেই ব্রজবুলি পদের ছন্দোনিপুণ কবি। ‘নায়িকা রত্নমালা’ সঙ্কলনে চন্দ্রশেখরের স্বরচিত ৪৫টি পদ বর্তমান। পদাবলীতে আর একজন চন্দ্রশেখর ছিলেন চৈতন্যের অন্তরঙ্গ পরিকর চন্দ্রশেখর আচার্য ; ইনি কোমল ও প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদের রচয়িতা।
চাঁদ কাজী
(পরিচয় অজ্ঞাত)
১৭. জয়দেব
বীরভূমের অজয় নদের তীরে কেঁদুলি বা কেন্দুবিল্ব গ্রামের অধিবাসী। পিতার নাম ভোজদেব, মাতা বামাদেবী, স্ত্রী পদ্মাবতী। দ্বাদশ শতকের শেষভাগে লক্ষণ সেনের রাজসভার অন্যতম সভাকবি ছিলেন। জয়দেবের রচিত সংস্কৃত কাব্যের নাম ‘গীতগোবিন্দ’।
১৮. জগন্নাথ দাস
ব্যক্তিগত পরিচয় অজ্ঞাত। জগন্নাথ দাসের নৌকাবিলাস ও রাসের পদগুলি প্রসিদ্ধ।
১৯. জগদানন্দ
শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দন ঠাকুরের বংশধর জগদানন্দ ছিলেন অষ্টাদশ শতকের কবি। পিতার নাম নিত্যানন্দ বা মদন ঠাকুর। দুবরাজপুরের জোফলাই গ্রামে কবি জগদানন্দ প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথ বিগ্রহ ও গৌরাঙ্গ মূর্তি বর্তমান। ১৭৮২/৮৩ খ্রি. জগদানন্দের তিরোধান। পদাবলী ছাড়া জগদানন্দের ‘ভাষা শব্দার্ণব’ নামে একখানি সমধ্বন্যাত্মক শব্দকোষের খসড়া গ্রন্থ পাওয়া যায়। কবি ছিলেন ছন্দোনিপুণ।
২০. জ্ঞানদাস
বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণ বংশে জ্ঞানদাসের জন্ম। কবি ছিলেন নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবাদেবীর শিষ্য ও অনুচর। খেতুরীর বৈষ্ণব মহোৎসবে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং এখানে সমসায়িক কবি বলরাম দাসও গোবিন্দদাসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।
২১. নরহরি (সরকার)
পদাবলি সাহিত্যে নরহরি প্রধানত দুজন। একজন ষোড়শ শতকের নরহরি সরকার। শ্রীখণ্ডের বৈদ্যবংশে এঁর জন্ম। পিতার নাম নরনারায়ণ দেব ; মাতার নাম গৌরীদেবী। বয়সে গৌরাঙ্গের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। ছাত্রাবস্থা থেকে নিমাই-এর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। পরে গৌরাঙ্গের একান্ত ভক্ত হন এবং নবদ্বীপ নীলার অন্তরঙ্গ পরিকর ছিলেন। পুরীতে রথযাত্রাকালে শ্রীচৈতন্য অনুবর্তী সপ্ত কীর্তন সম্প্রদায়ের অন্যতম দলের নেতা হতেন নরহরি। সর্বপ্রথম তিনিই শ্রীখণ্ডে গৌরাঙ্গ পূজার প্রবর্তক। চৈতন্য-বিষয়ক প্রথম বাংলা পদের রচয়িতা। রঘুনন্দন, লোচনদাস তাঁর শিষ্য। গৌরনাগরবাদের প্রবর্তক নরহরি সমসাময়িক নবদ্বীপ বৈষ্ণবসমাজে কিছুটা উপেক্ষিত ছিলেন।
২২. নরহরি (চক্রবর্তী)
অপর নরহরি হলেন অষ্টাদশ শতকের নরহরি চক্রবর্তী। পিতা জগন্নাথ চক্রবর্তী। কবি প্রথম জীবনে নবদ্বীপ থাকলেও পরে গার্হস্থ্য ধর্ম ত্যাগ করে বৃন্দাবনে বাস করেন। ভক্তিরত্নাকর, নরোত্তমবিলাস, শ্রীনিবাসচরিত্র, গীতচন্দ্রোদয়, গৌরচরিত্রচিন্তামণি প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা নরহরি চক্রবর্তীর সংস্কৃত সাহিত্যে ও ছন্দসঙ্গীতে গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল। ঘনশ্যাম ও নরহরি উভয় ভণিতাতেই তিনি পদ রচনা করেছেন।
২৩. নরোত্তম ঠাকুর
রাজশাহী জেলার গোপালপুর পরগণার অধিপতি রাজা কৃষ্ণাদন্দ দত্তের পুত্র। মাতা নারায়ণী। পিতার মৃত্যুর পর বিষয়-বিরাগী নরোত্তম পিতৃব্যপুত্র সন্তোষ দত্তকে রাজ্যভার দিয়ে বৃন্দাবনে লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্য হন। পিতৃ-রাজধানী খেতুরীতে আনুমানিক ১৫৮১ খ্রি. নরোত্তমের চেষ্টায় এক ঐতিহাসিক বৈষ্ণব মহোৎসব হয়েছিল। প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, সিদ্ধভক্তিচল্দ্রিকা, রসভক্তিচন্দ্রিকা প্রভৃতি বহু গ্রন্থ তাঁর নামে প্রচলিত। নরোত্তম ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ কীর্তন গায়ক। তাঁর প্রার্থনা পদগুলি সুবিখ্যাত।
২৪. নৃসিংহ
অষ্ট কবিরাজের অন্যতম বৈষ্ণব পদকর্তা নৃসিংহ ষোড়শ শতকের শেষভাগে বর্তমান ছিলেন। এঁর উপাধি কবিরাজ। ভক্তিরত্নাকরের দশম তরঙ্গে খেতুরীর মহোৎসব বর্ণনা প্রসঙ্গে নরোত্তম ঠাকুরের যে শিষ্যসঙ্গীবর্গের বর্ণনা আছে সেখানে নৃসিংহ কবিরাজ ও তাঁর ভ্রাতা নারায়ণের নাম আছে।
নসির মামুদ
পরিচয় অজ্ঞাত।
২৫. বলরাম দাস
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে একাধিক বলরাম দাসের অস্তিত্ব বর্তমান। তার মধ্যে প্রেমবিলাস কাব্য রচয়িতা শ্রীখণ্ডবাসী নিত্যানন্দ বলরাম নামে যেমন পদ লিখেছেন তেমনি ‘কৃষ্ণলীলামৃত’ কাব্য রচয়িতা দীন বলরামের পদ আছে। কিন্তু পদাবলীখ্যাত মুখ্যতঃ দুজন। তার মধ্যে একজন দোগাছিয়া গ্রামের বলরাম দাস। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে এঁর জন্ম। নিত্যানন্দের নিকট ইনি দীক্ষিত হন। কবি ছিলেন কৃষ্ণের বালগোপাল মূর্তির উপাসক।। বাৎসাল্যের পদে তিনি শ্রেষ্ঠ। প্রধানতঃ বাংলা ভাষায় পদ রচনায় তিনি বিখ্যাত।
ব্রজবুলি পদে খ্যাতি অর্জন করেছেন একজন পরবর্তীকালের বলরাম দাস (কবিরাজ)। ইনি গোবিন্দদাস কবিরাজের ভাগিনেয় বলে প্রসিদ্ধ। মতান্তরে গোবিন্দদাসের পৌত্র ঘনশ্যামই বলরাম।
২৬. বল্লভদাস
বল্লভদাস নামে দুজন পদকর্তার পরিচয় পাওয়া যায়। একজন হলেন নরোত্তম দাসের শিষ্য বল্লভ। ইনিই পদাবলি-প্রসিদ্ধ বল্লভদাস।
এ ছাড়া ‘বংশীলীলা’ গ্রন্থের রচয়িতা বল্লভদাস ছিলেন বংশীবদনের পৌত্র এবং শচীনন্দনের পুত্র। পূর্বোক্ত বল্লভদাসের সঙ্গে এর কিছু রচনা মিশে যাওয়া সম্ভব।
২৭. বসন্ত রায় ও রায় বসন্ত
বসন্ত রায় ছিলেন নরোত্তম-শিষ্যদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য বৈষ্ণব পদকার। গোবিন্দদাসের পদে এঁর উল্লেখ থাকায় মনে হয় পরস্পর বন্ধু ছিলেন। গোবিন্দদাসের উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি বৃন্দাবনবাসী হন বলে প্রসিদ্ধি। এই বসন্ত রায় যশোরের প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে।
২৮. বংশীবদন ও বংশীদাস
নবদ্বীপে গৌরাঙ্গের বয়ঃকনিষ্ঠ প্রতিবেশী ছিলেন বংশীবদন। পিতার নাম ছ কড়ি ও মাতার নাম চন্দ্রকলা। চৈতন্যের নীলাচলে গমনের পর শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়ার দেখাশোনা করতেন বংশীবদন। তিনি পদাবলী রচনায় বংশীবদন ও বংশীদাস দুরকম ভণিতা ব্যবহার করতেন। ষোড়শ শতকে সম্ভবতঃ আর একজন বংশীদাস ছিলেন যিনি একখানি রাগরাগিণী চিহ্নিত গীতিপ্রধান কৃষ্ণায়ন কাব্য রচনা করেন। সপ্তদশ শতকে শ্রীনিবাস আচার্যের এক শিষ্যের নাম ছিল বংশীদাস ; তিনিও পদকর্তা ছিলেন।
২৯. বাসুদেব ঘোষ
বল্লভ ঘোষের পুত্র বাসুদেব অপর দুই ভ্রাতা মাধব ও গোবিন্দ অপেক্ষা পদ রচনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। চৈতন্যাশ্রিত কবি বাসুদেব নিমাই সন্ন্যাস পালাগান রচনা করে অত্যন্ত খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
৩০. বিদ্যাপতি
বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার রাজসভার কবি। বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার বিসফী গ্রামে আনুমানিক ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে কবির জন্ম। পিতা গণপতি। কবি মিথিলার ওইনিবার রাজবংশের সাতজন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়। শিবসিংহ রূপনারায়ণের সভাকবি রূপে তিনি অনেকগুলি রাজনামাঙ্কিত পদ রচনা করেন। রাধাকৃষ্ণ পদ ছাড়া শিববিষয়ক পদ এবং কীর্তিলতা, ভূপরিক্রমা, পুরুষ-পরীক্ষা, শৈবসর্বস্বহার, গঙ্গাবাক্যাবলী, বিভাগসার, দানবাক্যাবলী, লিখনাবলী, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী প্রভৃতি বহু গ্রন্থের রচয়িতা রূপে বিদ্যাপতি স্বদেশে বিখ্যাত। শেষজীবনে তিনি অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন বলে জানা যায়। বিদ্যাপতির উপাধি ছিল ‘অভিনবজয়দেব’।
৩১. বৃন্দাবন দাস
শ্রীচৈতন্যের অনুচর শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী নারায়ণীর পুত্র বৃন্দাবন দাসের পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত। আনুমানিক ১৫২০-২২ খ্রিস্টাব্দে কবির জন্ম। নবদ্বীপের নিকটবর্তী মামগাছি গ্রামের তাঁর প্রথমজীবন কাটে। শেষজীবনে তিনি বর্ধমানের দেনুড় গ্রামে থাকেন। চৈতন্যের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে না এলেও কবি নিত্যানন্দের ঘনিষ্ঠশিষ্য ছিলেন। আঃ ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে সুবিখ্যাত ‘চৈতন্যভাগবত’ রচনা করেন। খেতুরী উৎসবকালে তিনি জীবিত ছিলেন। এর অন্যান্য গ্রন্থ তত্ত্ববিলাস, বৈষ্ণববন্দনা, ভক্তিচিন্তামণি।
৩২. বৈষ্ণবদাস
বৈষ্ণবদাসের আসল নাম গোকুলানন্দ সেন। জাতিতে বৈদ্য, নিবাস কাটোয়ার কয়েক ক্রোশ উত্তরে টেঙা বৈদ্যপুর গ্রামে। গোকুলানন্দ বা বৈষ্ণবদাসের বন্ধু ছিলেন উদ্ধবদাস। কথিত হয় এঁরা ১৭১৮ খ্রি. রাধামোহন ও কৃষ্ণদেবের সুবিখ্যাত স্বকীয়া-পরকীয়া মতের বিতর্কসভায় উপস্থিত ছিলেন। বৈষ্ণবদাস পদরচয়িতা অপেক্ষা সর্ববৃহৎ বৈষ্ণবপদ সংকলন ‘পদকল্পতরু’র সঙ্কলক বলেই সমধিক প্রসিদ্ধ।
৩৩. ভূপতি
ভূপতি সিংহকে কেউ বলেছেন বিদ্যাপতির নামান্তর। কেউ এঁকে বলেছেন কবি চম্পতি। ইনি আসলে উত্তররাঢ়ের জমিদার নরসিংহ। শ্রীনিবাস আচার্যের অনুরক্ত। সহজিয়া বৈষ্ণবরা এঁকে বলতেন ‘রসিক’ মহাজন।
৩৪. মাধব ঘোষ
গোবিন্দ ঘোষ ও বাসুদেব ঘোষের ভ্রাতা মাধব ঘোষ ছিলেন বল্লভের পুত্র। গৌরাঙ্গের নিকট আত্মসমর্পণ করে দুই ভাইয়ের সঙ্গে ইনিও চৈতন্যের নবদ্বীপ লীলার পরিকর হন। মাধব ছিলেন কীর্তন গানে ভ্রাতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাংলায় গৌরপদ ছাড়া ব্রজবুলিতে মাধবের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কিছু পদও বর্তমান।
৩৫. মালাধর বসু
বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কুলীনগ্রামে কবির জন্ম। পিতার নাম ভগীরথ ; মাতার নাম ইন্দুমতী। গৌড়েশ্বর রুকুনুদ্দীন বারবক শাহের নিকট কবি ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধি লাভ করেন। ১৪৭৩ থেকে ১৪৮০ খ্রি. পর্যন্ত ৭ বছরে রচিত কবির ‘গোবিন্দমঙ্গল’ বা ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যটি ভাগবতের দশম-একাদশ স্কন্ধের অনুবাদ। কবির পুত্রের নাম সত্যরাজ খান।
৩৬. মুরারি গুপ্ত
নিমাই-এর সহধ্যায়ী ও বাল্যসঙ্গী মুরারির আদিনিবাস শ্রীহট্টে। পরে নবদ্বীপে এসে বাস করেন। গৌরাঙ্গের চেয়ে মুরারি বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন কিন্তু তাঁকে ব্যাকরণে নিমাই ব্যতিব্যস্ত করতেন। প্রথমে মুরারি ছিলেন অদ্বৈতপন্থী ও রামোপাসক। পরবর্তীকালে গৌরাঙ্গের ভক্তিপ্রভাবে ভক্তিবাদে দীক্ষিত হলেও রামোপাসনায় অচল ছিলেন। একনিষ্ঠভাবে রামের উপাসক ছিলেন বলে বৈষ্ণববিশ্বাসে তিনি হনুমানের অবতার। পদাবলী ছাড়াও তাঁর বিখ্যাত রচনা সংস্কৃত কড়চা ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম’ প্রথম চৈতন্যজীবনী।
৩৭. যদুনন্দন দাস
সপ্তদশ শতকের কবি যদুনন্দন দাস কাটোয়ার নিকটবর্তী মালিহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি জাতিতে বৈদ্য। কবি শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য এবং শ্রীনিবাসের কন্যা হেমলতাদেবীর অনুচর ছিলেন। রূপ গোস্বামীর বিদগ্ধমাধব নাটক, বিল্বমঙ্গল ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকর্ণামৃত’ এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘গোবিন্দলীলামৃত’ ইত্যাদি গ্রন্থ অনুবাদ করে যদুনন্দন বিখ্যাত হন। মূলত অনুবাদক হলেও তাঁর রচনা নিছক অনুবাদ নয়।
এছাড়া ষোড়শ শতকে অদ্বৈত গণভুক্ত আর এক যদুনন্দনাচার্য গৌরাঙ্গের ‘অদ্ভুত চরিত’ লেখেন এবং নিত্যানন্দ পার্ষদ যদুনন্দন চক্রবর্তীর নামেও কিছু পদ পাওয়া যায়।
৩৮. যদুনাথ দাস
যদুনাথ দাস নামে যিনি গৌরাঙ্গ ও রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন সেই যদুনাথ চক্রবর্তী ছিলেন নিত্যানন্দের সমসাময়িক এবং নিত্যানন্দ শিষ্য গদাধরের অনুচর বলে প্রসিদ্ধ।
৩৯. যাদবেন্দ্র
অষ্টাদশ শতকের কবি যাদবেন্দ্র ছিলেন বীরভূমের কচুজোড়ের রাজা রুদ্রচরণ রায়ের গুরুদেব যাদবেন্দ্র ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষায় লেখা কবির সখ্য ও বাৎসল্য রসের পদগুলি বিখ্যাত।
৪০. রাধামোহন ঠাকুর
শ্রীনিবাস আচার্যের প্রপৌত্র রাধামোহন ঠাকুর ছিলেন অষ্টাদশ শতকের বৈষ্ণব পদকার এবং বৈষ্ণবপদ সঙ্কলক।-তাঁর পদ সঙ্কলনের নাম ‘পদামৃতসমুদ্র’, ১৭২৫ খ্রি. মধ্যে সঙ্কলিত। এর সংস্কৃতে রচিত টাকা ‘মহাভাবানুসারিণী’ ও তাঁরই রচনা। ১৭১৮ খ্রি. জয়পুর থেকে আগত স্বকীয়াবাদী কৃষ্ণদেবকে বিতর্কে পরাজিত করে রাধামোহন পরকীয়ামতের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করেন। পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের জন্য তিনি সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবাচার্য।
৪১. রামানন্দ বসু
বর্ধমানের অন্তর্গত কুলীনগ্রামের মালাধর বসুর বংশজ (পৌত্র?) রামানন্দ বসু গৌরাঙ্গ পরিজন ছিলেন। প্রতি রথবাত্রার সময় কুলীন গ্রামের ভক্তদের নিয়ে রামানন্দ নীলাচলে যেতেন ও মহাপ্রভুর সান্নিধ্য লাভ করতেন। বসু রামানন্দের ভণিতায় বাংলা ও ব্রজবুলি পদগুলি উৎকৃষ্ট।
চৈতন্যপ্রসাদবঞ্চিত রামানন্দ দাস নামে আর একজন পদকর্তার পদ রামানন্দ ভণিতায় পাওয়া যায়। ইনি চৈতন্যোত্তর যুগের কবি।
৪২. রায় রামানন্দ
উড়িষ্যার নৃপতি গজপতি প্রতাপ রুদ্রের রাজত্বকালে (১৪৮৯ – ১৫৪০ খ্রি.) অধীনস্থ বিদ্যানগরের প্রধান রাজপুরুষ ছিলেন রায় রামানন্দ। পিতার নাম ভবানন্দ রায়। গোদাবরী তীরে চৈতন্যদেবের সঙ্গে রামানন্দের সাক্ষাৎ হয়। রাজবৈভব ছেড়ে রামানন্দ চৈতন্যচরণে আত্মসমর্পণ করেন।চৈতন্যদেবের অন্ত্যলীলার অন্তরঙ্গ পরিকর ছিলেন রায় রামানন্দ। রামানন্দের সংস্কৃত ভাষায় কৃষ্ণলীলা বিষয়ক নাটকটির নাম ‘জগন্নাথবল্লভ’।ব্রজবুলিপদটি চৈতন্যের সঙ্গে গোদাবরী তীরে সাধ্যসাধনতত্ত্ব আলোচনার শেষে রামানন্দ শুনিয়েছিলেন বলে চৈতন্যচরিতামৃতে উদ্ধৃত।
৪৩. রূপ গোস্বামী
গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের দবীরখাস্ বা একান্ত সচিব রূপ রামকেলিতে চৈতন্যদেবের সাক্ষাৎলাভের পর সংসার ত্যাগ করে চৈতন্যপদাশ্রয় গ্রহণ করেন এবং চৈতন্য-নির্দেশে অবশিষ্ট জীবন বৃন্দাবনে অতিবাহিত করেন। ‘হংসদূত’ ও ‘উদ্ধবসন্দেশ’ কাব্য রূপ গৌড়ে থেকেই রচনা করেন। বৃন্দাবনে রচনা করেন ‘বিদগ্ধমাধব’, ‘ললিতমাধব’, ‘দানকেলিকৌমুদী’ প্রভৃতি নাটক ;‘ভক্তিরসামৃত-সিন্ধু’ ও ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ প্রভৃতি রসশাস্ত্র ও গীতাবলীর অনেক গান। জয়দেবানুসারী গীতগুলিতে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সনাতনের ভণিতা থাকলেও গানগুলি যে আসলে রূপেরই রচনা এ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়েছেন গানগুলির টীকায় রূপের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীজীব গোস্বামী।
৪৪. লোচন দাস
বর্ধমান জেলার অন্তর্গত মঙ্গলকোটের নিকট কোগ্রামে লোচন দাস বা ত্রিলোচন দাসের জন্ম। পিতার নাম কমলাকর দাস, মাতার নাম সদানন্দী। লোচনের বৈদ্যংশে জন্ম। নরহরি সরকার ছিলেন লোচনের দীক্ষাগুরু। নরহরির গৌরনাগর-বাদের প্রচারক ছিলেন লোচন দাস। ১৫৩৭ খ্রি. লোচন দাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্য রচিত হয়। ছড়ার ছন্দে ধামালি জাতীয় পদরচনা লোচন দাসের পদাবলির বিশিষ্টতা।
৪৫. শঙ্করদেব
আনুমানিক ১৪৬১ খ্রি. ব্রহ্মপুত্রের তীরস্থিত নওগাঁ জেলার বড়দোয়া গ্রামে কায়স্থ ভূস্বামীর গৃহে জন্ম। শঙ্করদেবের পিতার নাম কুসুমবর। আসামে বৈষ্ণর ভক্তি আন্দোলনের নেতা শঙ্করদেবের সঙ্গে সম্ভবতঃ নীলাচলে শ্রীচৈতন্যের সাক্ষাৎ হয়। শেষজীবন (১৫৬০-১৫৬৮ খ্রি.) শঙ্করদেব কামতার রাজা নবনারায়ণের আশ্রয়ে ছিলেন। শঙ্করের পদাবলীর সঙ্গে বিদ্যাপতির পদের যেমন সাদৃশ্য আছে তেমনি ব্রজবুলি পদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সংযাগে বর্তমান।
৪৬. শশিশেখর
কাঁদ্ড়া গ্রামের গোবিন্দানন্দ ঠাকুরের পুত্র শশিশেখর অষ্টাদশ শতকের পদকর্তা। এঁর ভাই-এর নাম চন্দ্রশেখর। মতান্তরে শশিশেখর ও চন্দ্রশেখর এক ব্যক্তি। ‘নায়িকা রত্নমালা’ সংকলনে ১৪টি পদ শশিশেখরের রচনা। ব্রজবুলি রচনায় চন্দ্রশেখরও শশিশেখর উভয়েই সুনিপুণ। তবে চন্দ্রশেখরের গাম্ভীর্য বেশি কিন্তু শশিশেখরের তারল্য অধিক।
৪৭. শ্রীনিবাস আচার্য
ষোড়শ শতকের শেষদিকে ও সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে বাংলাদেশে বৈষ্ণব সমাজের অন্যতম প্রধান নেতা শ্রীনিবাস আচার্য ছিলেন নদীয়ার চাখন্দী গ্রামের অধিবাসী। পিতার নাম গঙ্গাধর ভট্টাচার্য, মাতার নাম লক্ষ্মী। পিতৃবিয়োগের পর বৃন্দাবনে গোপাল ভট্টের কাছে শ্রীনিবাসের বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষাও জীবের কাছে বৈষ্ণবশাস্ত্রে শিক্ষা হয়। পরে বাংলাদেশে ফিরে বৈষ্ণব সমাজের প্রধান আচার্য হয়েছিলেন। রচনাকার্য অপেক্ষা প্রচারকার্যে বাংলাদেশে ফিরে তিনি তিনি উৎসাহী ছিলেন। তাঁর নামে কয়েকটি বাংলা পদও পাওয়া যায়।
সাহ আকবর
পরিচয় অজ্ঞাত।
৪৮. সৈয়দ মতুর্জা
মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুরের নিকটবর্তী বালিয়াঘাটা নামক পল্লীতে কবির জন্ম। পিতা হাসান কাদেরী। কোন কোন মতে ইনি চট্টগ্রামের কবি। কবির নামে ২৮টি রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক পদ পাওয়া গেছে।
৪৯. হাম্বীর
বিষ্ণুপুরের মল্লভূমির অধিপতি বীর হাম্বীর শ্রীনিবাস আচার্যের নিকট বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। দীক্ষান্তে তাঁর নাম হয় শ্রীচৈতন্যদাস। কালাচাঁদ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করে ইনি নিজ রাজ্যে বৈষ্ণব ভক্তির প্রসার ঘটান। এঁর নামে দু’একটি ভাল পদ পাওয়া যায়।
বৈষ্ণব কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়" লেখাটির জন্য ঋণী দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় -এর বইয়ের কাছে।