প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে দূতী-সহচরী

লিখেছেন সুখেন মণ্ডল



১.

প্রাগ্‌-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের type কিংবা individual চরিত্রের প্রবাহে কিছু চরিত্র ঘুর্ণিস্রোতের মতো পাঠকের মনকে দোলায়িত করে। স্বাভাবিকভাবেই এইসব অতি-উজ্জ্বল চরিত্রগুলি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আখ্যানকাব্যগুলিতে প্রায়ই নায়ক বা নায়িকার দূতী-সহচরীরূপে কিছু চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করি, যারা কাহিনী-অংশে অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রামায়ণের মন্থরাকে এইসব চরিত্রের পূর্বজ বলা যায়, যাদের ভূমিকা নিয়ে দ্বিমত হবার জো নেই। মধ্যযুগের কাব্যে আমরা এইরকমই কুট্টিনীজাতীয়া চরিত্র যেমন পেয়েছি তেমনই মনসার সহচরী নেত’র মতো সুপরামর্শদাত্রীকেও পেয়েছি। তবে দুই জাতীয় চরিত্রেরই উপস্থিতি সহচরী রূপে। এই ধরনের কয়েকটি চরিত্রকে আমরা তালিকাবদ্ধ করতে পারি—

১। বড়ায়ি (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)

২। হেতুবতী (লায়লী-মজনু)

৩। দুর্বলা, লীলাবতী (চন্ডীমঙ্গল-ধনপতি উপাখ্যান)

৪। বুদ্ধিশিখা, রত্নামালিনী (সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী)

৫। হীরামালিনী, সাধী-মাধী (অন্নদামঙ্গল)

–এই চরিত্রগুলিকে কিন্তু অনায়াসে এক শ্রেনীতে অন্তর্ভূক্তকরা যায় না। কখনো কখনো দু-একটি চরিত্র কাহিনীর জন্য অবশ্য-প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে আবার কয়েকটি চরিত্র শুধুমাত্রই টাইপধর্মী। এগুলির মধ্যে বড়াই-ই নিঃস্বার্থ দূতীর মধ্যে অন্যতম। আর একটি চরিত্র বড়াই-এর মতোই দূতীর কাজ করেছে ‘লোরচন্দ্রানী’র বুদ্ধিশিখা। এদের বিপরীতে পেয়েছি দুর্বলা, লীলাবতী, রত্নামালিনী কিংবা হীরামালিনীকে।

এই ধরনের চরিত্রবৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের একজনকে পাই সে হলো মনসার সহচরী নেত বা নেতা। নেতকে বরং বলা চলে দেবী মনসার উপদেশক, যার ভূমিকা মনসামঙ্গল কাব্যে সর্বব্যাপী। মনসার সর্বসময়ের সহচরী নেত মনসামঙ্গল কাব্যের উপেক্ষিত একটি চরিত্র। আমাদের আলোচ্য নিবন্ধের অন্য চরিত্রের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোটিতে তার অবস্থান। নেত চরিত্রের মহত্ত্বের দিকগুলি আলাদা প্রবন্ধে আলোচনা করা যায়। এখানেও নেত চরিত্রটিকে উপেক্ষিত রাখা হলো।  

২.


প্রথমেই উল্লেখ করতেই হয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ায়ি চরিত্রটির কথা। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমবন্ধনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে সে কাব্যে নিজ গুরুত্ব নিঃসংশয়রূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। বড়ায়ির ভূমিকা সম্বন্ধে কবি ‘জন্মখণ্ডে’ আমাদের জানিয়ে দেন—

“নিয়োজিলী নানা পরকারে। আল।

 হাটে বাটে রাধা রাখিবারে।।” 

অর্থাৎ সুন্দরী রাধাচন্দ্রাবলীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে বড়ায়ি নিযুক্ত হলেন, এখানে তার ভূমিকা সহচরী রূপে। অথচ চমৎকারভাবে ‘তাম্বুলখণ্ডে’ তার এই ভূমিকার পরিবর্তন লক্ষ করি। বনমধ্যে রাধাকে হারিয়ে উদ্‌বিগ্ন বড়ায়ি কৃষ্ণের প্রস্তাবে রাজি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বড়ায়িকে কৃষ্ণ তখনি রাধার সংবাদ জানায় যখন বড়ায়ি কৃষ্ণের প্রেম প্রস্তাব রাধার কাছে নিয়ে যাবে বলে কথা দেয়। তাহলে এটা স্পষ্ট যে বড়ায়ি দূতীগিরির সূচনা অনেকটাই কৃষ্ণের দ্বারা সংঘটিত, বাধ্য হয়েছে বড়ায়ি দূতীগিরিতে সম্মত হতে। তাছাড়া কৃষ্ণের স্বরূপ তো বড়ায়ির অজানা নয়, তাই কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার প্রেম-নির্বন্ধে বড়ায়ি সংকুচিত হয়নি।

কিন্তু এর পরবর্তী খণ্ডগুলিতে বড়ায়ির কর্মকাণ্ড পাঠকের সমর্থন হয়তো পায় না। কৃষ্ণের সঙ্গে নানা পরামর্শ করে বারবার রাধাকে বাধ্য করেছে কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতে যেতে। অথচ ‘বংশীখণ্ড’-এ এই বড়ায়ির অন্যরূপ পাঠকের মনকে কিছুটা শান্তি দেয়। এই অংশে কৃষ্ণের দূতী বড়ায়ি শুধুমাত্র  আর কৃষ্ণের দূতী থাকেনি; রাধার প্রকৃত সহচরী হয়ে উঠেছে। সে-ই রাধাকে পরামর্শ দিয়েছে বংশী চুরি করার –

“নিন্দাউলী মন্ত্রে যাক নিন্দাইব আহ্মি।

 তবেঁ তার বাঁশী লআঁ ঘর জাইহ তুহ্মি।।”

রাধা-কৃষ্ণ উভয়ের প্রতিই বড়ায়ি সহানুভূতিশীল,দূতীরূপে তার দ্বৈত ভূমিকা অধিক উজ্জ্বল,এ হিসাবে সে একমেবদ্বিতীয়ম্‌ও বটে। বংশীখণ্ডেই বড়ায়ি রাধার friend এবং guide. অনেকের হয়তো মনে হতে পারে বিবাহিতা রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম-নির্বন্ধের মধ্যে দোষ রয়েছে, কিন্তু বড়ায়ি ভালোভাবেই জানে রাধার পতি আইহন নপুংসক, শুধু তাই নয় কাহ্নাঞি যে ত্রিলোকেশ্বর সেখানে তার দূতীগিরির মধ্যে অগৌরবের তো কিছু নেই। শেষপর্যন্ত বড়ায়ি হয়ে উঠেছে রাধারই প্রকৃত সহচরী। তাই তাকে শুধু কুট্‌নী চরিত্র হিসাবে উপেক্ষা করা অনুচিত—

“বড়ুচণ্ডীদাস বড়াইকে একটি কুট্টিনী চরিত্র রূপে শুরু করিয়া ছিলেন, কিন্তু স্নেহ-প্রীতি-মমতায় পরিপূর্ণ একটি চরিত্ররূপে সম্পূর্ণ করিয়াছেন।”   

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ‘বংশীখণ্ড’-এ বড়ায়ি রাধার সমব্যথী। সপ্তদশ শতকে বড়ায়িরই সমগোত্রীয় আর একজনকে পেয়ে যাই। বড়ায়ির মতো নয় কিন্তু সমগোত্রের, সে হল বুদ্ধিশিখা; দৌলতকাজির ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’র অন্যতমা নায়িকা চন্দ্রানীর ধাই। বড়ায়ির সঙ্গে বুদ্ধিশিখার মিল-অমিল দুইই রয়েছে। অমিলের প্রসঙ্গটা আগে বলে নিই। বড়ায়ি তো প্রথমে রাধার দুঃখে দুঃখী  হয়নি, তার তো অবস্থান্তর ঘটেছিল। কিন্তু বুদ্ধিশিখা প্রথম থেকেই চন্দ্রানীর প্রতি স্নেহশীলা। ‘মধুরভাষিণী’ ‘লোকপ্রিয়া’ এই ধাই চন্দ্রানীর মনোদুঃখ জানতেমিষ্ট কথায় জানায়—

“শিশু হন্তে তোকে মুই করিলুঁ পালনা।

 মোকে কেনে গুপ্ত কর্ম অন্তরে বেদনা।।”

— মাতৃসমা আচরণেই সে থেমে থাকেনি,একজন বন্ধুর মতো প্রকৃত সহচরীর মতো জানতে চেয়েছে-

“সত্য কহ কাহাকে মজিল তোর মন।”

চন্দ্রানীর আরক্ত মুখ দেখে সেই অজানা প্রেমিক-পুরুষটিকে ‘মহামন্ত্র আহুতিমু আকর্ষণ বলে’র দ্বারা চন্দ্রানীর সামনে হাজির করতে চেয়েছে।

আরো পড়ুন :  পুথি, প্রথম পর্ব

যাইহোক বুদ্ধিশিখা তার বুদ্ধির চাতুর্যে রাজা লোরের সঙ্গে চন্দ্রানীর মিলন সংঘটিত করেছে। তার উদ্দেশ্য ও আচরণের মধ্যে কোন ফাঁক নেই। তাই তার মতো চরিত্র সকল সময়েই আমাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত হয়, এখানেই বুদ্ধিশিখার জয়।

৩.


এবার মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যের ব্যাপক বিচিত্র চরিত্রের মিছিলের মাঝে অন্তত দুটি চরিত্রের কথা বলা যায়, যারা স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল – চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ‘ধনপতি উপাখ্যান’ অংশের দুর্বলা এবং অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘বিদ্যাসুন্দর’ অংশের হীরামালিনী। এদের মধ্যে দুর্বলা প্রাচীনা, তাই তার সম্পর্কে আগে আলোচনা করা যাক।

“যেই ঘরে দুই সতীনে না হয় কন্দল।

 সেই ঘরে চেড়ী থাকে সে বড় পাগল।।” 

 (‘দুর্বলা দাসীর চিন্তা’ অংশ)

— সামান্য এই ছত্র দুটিতেই দুর্বলার সমস্ত অন্তকরণ যেন একমুহূর্তেই পড়ে ফেলা যায়। ধনপতি সদাগর-এর দুই স্ত্রী – লহনা ও খুল্লনা। এই দুই সতীনের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক দাসী দুর্বলার দু’চোখের বিষ, কেননা তার কাছে তা মোটেই সুখকর নয়। দুই সতীনের প্রীতি-মধুর সম্পর্ক বাড়ির দাসীর চোখের বালি স্বরূপ। সে কারণেই বড়োবধূ লহনাকে মন্ত্রণা দেয়—

“সতিনী আপনা নহে মাথা কাটি দিলে।”

 (‘দুর্বলার উপদেশ’ অংশ)

প্রভুপত্নী লহনার অন্তরে বিরুদ্ধভাব জাগাতে দুর্বলা অস্ত্র হিসাবে তুলে নেয় খুল্লনার সুন্দর রূপকে, খুল্লনার রূপের সঙ্গে লহনার রূপের তুলনা করে– এখানে দুর্বলা সর্বাংশে সফল হয়। দাসী দুর্বলার কু-পরামর্শে লহনার মন বিষিয়ে ওঠে। এরপর সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্বলাকে তার বাল্যবন্ধু লীলাবতীর কাছে পাঠায়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, দুর্বলার এ হেন আচরণ ধনপতির অবর্তমানে পুষ্ট হয়েছে, শুধু তাই নয় ধনপতির গৃহাগমনে দুর্বলার কাঙ্ক্ষিত ভাবান্তর যে তার চরিত্রকে দুর্বল করেছে তা শেষাংশে উল্লেখিত।

লহনার বাল্যবন্ধু লীলাবতীও সামান্য নারী ছিল না ; ছয় সতীনের ঘরেও সে দিব্যি নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছে—

“শাশুড়ি ননদী /

 ঔষধেত বান্ধি /

 সবে মোর বল ধরে।।”  

এ হেন লীলাবতী খুল্লনাকে কষ্ট দিতে কপট পত্রে ছাগল চরানোর কথা বলে –

“নিযুক্ত করিবে তারে ছাগল রক্ষণে।”

এবং,“শয়ন করিতে তারে দিবে ঢেঁকিশালা।”

— ছাগল রক্ষণে যখন খুল্লনা দাসী দুর্বলার কাছে দুঃখের কথা জানায় তখন দুর্বলার অভিনয় একজন দক্ষ artist এর ন্যায় –

“খুল্লনার বাণী /

 দুর্বলা দাসী শুনি /

 কান্দিয়া করে নিবেদন।”

কী নিবেদন ? না –

“ছাগল রক্ষণ কর দিন দুই চারি।”

ছদ্ম-দুঃখে খুল্লনাকে ছাগল রক্ষণে হয়তো বাধ্যই করে দুর্বলা দাসী। আবার খুল্লনার মাতা রম্ভাবতীর কাছে তার দুর্দশার খবর পাঠায় এই দুর্বলাই। দাসী দুর্বলার এ হেন কপটতার আমূল পরিবর্তন লক্ষ করি ধনপতির স্বদেশ প্রত্যাগমনের পর। ধনপতি ফিরে এলেই দুর্বলা সর্বাগ্রে যার তার কাছেই যে ধনপতির প্রিয়,সে হলো খুল্লনা। সে জানে তাকে বাঁচতে হলে খুল্লনার মন পেতে হবে। তাই দেরি না করে খুল্লনার কাছে গিয়ে জানায় –

“আপন বলিয়া দুয়া রাখিবে চরণে ।

 দুবলা অন্যের দাসী নয় তোমা বিনে।।”

কিন্তু লহনাকেও দুর্বলা ত্যাগ করে না,তাকেও প্রসাধন সজ্জায় সাজিয়ে দেয় মনের মতো করে। আসলে দুর্বলা একটি ‘শ্রেণি-চরিত্র’, নিজের স্বার্থে সে দুই সতীনকেই খুশি করতে চেয়েছে। কবি এইভাবেই দুর্বলাকে টাইপ চরিত্রে নামিয়ে এনেছেন। এরপর দুর্বলাকে আর আগের মতো চেনা যায় না। তার চরিত্রের এই ‘আপাত আকস্মিক’ পরিবর্তন পাঠকদের পীড়া দেয়। এই চারিত্রিক পরিবর্তনকে আকস্মিক বললে পুরোপুরি ঠিক বলা হয় না ; কেননা type জাতীয় চরিত্রের পরিণতি এইরকমই— লেখকের চাহিদা পূরণ হলেই এদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। ধনপতির গৃহাগমনের পর থেকে দুর্বলার যেসব কর্মকাণ্ড আমরা প্রত্যক্ষ করি, যেমন :

“দুর্বলা কিঙ্করি গান কৃষ্ণের চরিত”

 (শ্রীমন্তের শৈশব অংশ)

বা, শ্রীমন্তের জন্য খুল্লনাকে কাঁদতে দেখে,

“দুবলা আনিয়া তার মুখে দেয় বারি”

  (শ্রীমন্তের দুঃখ নিবেদন অংশ)

–তা মোটেই পূর্বের দুর্বলার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায় না। বিপরীতে নবীনা হীরামালিনী অধিক উজ্জ্বল। এতটাই ঈর্ষণীয় যে সমালোচকের মন্তব্য তুলে বলা যায়-

“হীরামালিনী টাইপ বা মামুলি চরিত্র নহে,বঙ্গসাহিত্যে হীরামালিনী অনেক ফুল যোগাইয়াছে।”

অপিচ,

“অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্রগুলি আজ সম্পূর্ণ প্রাণহীন; কেবল ঐ কোন্দল-পরায়ণামালিনীটা আজও জীবিত, এতই সজীব যে কাছে যাইতে সাহস হয় না,পাছে ঝগড়াবাধাইয়া দেয়…” 

হীরামালিনীর পরিচয়ে ভারতচন্দ্র লিখেছেন –

“কথায় হীরার ধার হীরা তার নাম।

 দাঁত ছোলা মাজা দোলা হাস্য অবিরাম।

 …………………….

 বাতাসে পাতিয়া ফাঁদ কন্দল ভেজায়।

 পড়শী না থাকে কাছে কন্দলের দায়।।”

 (সুন্দরের মালিনী সাক্ষাৎ)

— সুন্দরের দূতী হয়ে হীরা গেছে বিদ্যার কাছে। হীরা পরিপূর্ণ দূতী, তার দূতীয়ালি বিষয়ে কোনরূপ সংশয়ের অবকাশ নেই। প্রাচীন কামশাস্ত্র বর্ণিত দূতী হল হীরা, সে আদর্শ দূতী। আদর্শ দূতী তারাই যারা –

“চতুরা প্রগল্‌ভাবতী পরিচিত্তজ্ঞানকৌশলোপেতা।

 যোজ্যা অস্মিন্‌ দূতী বক্রোক্তির্বিভূষিতা প্রযত্নেন।।”

 যারা হবে চতুরা,প্রগল্‌ভা,পরিচিত্তজ্ঞাননিপুণা,বক্রোক্তিতে পারদর্শিণী। ভারতচন্দ্রের হীরা বিদ্যার রূপ বর্ণনায় সিদ্ধহস্তা–

“কে বলে শারদ-শশী সে মুখের তুলা।

 পদনখে পড়ি তার আছে কত গুলা ।।”

 (বিদ্যার রূপ-বর্ণন )

হীরামালিনী কোনরূপ নীতির ধার ধারে না,শুভবুদ্ধি তার নেই,ভাবভঙ্গীতে তার ছলনা,সুন্দরের কাছে অর্থ লাভের জন্যই সে এই পরিণয়-নির্বন্ধে দূতিয়ালির ভূমিকা গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয় বিদ্যাকে নানাভাবে প্ররোচিত করেছে। তাই যখন সুন্দর ধরা পড়ে মালিনীকে ‘মাসি’ সম্বোধন করে তখন হীরা রুষ্টস্বরে সুন্দরকে গালি দেয় –

“মালিনী রুষিয়াবলে গালি দিয়াকে তুই কে তোর মাসি।”

— স্বার্থান্বেষী হীরার এরূপ আচরণে হয়তো হীরার পদ অবনতি ঘটেছে,টাইপজাতীয় চরিত্রবৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি।

আরো পড়ুন :  ব্রজবুলি সাহিত্যের আদি কবি

৪.


দুর্বলা-হীরাদের পাশাপাশি আরো কয়েকটি চরিত্রকে রাখা যায় তারা হল,

ক। দৌলত উজীর বাহরম খানের ‘লায়লী-মজনু’র হেতুবতী

খ। দৌলত কাজীর  ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’র রত্নামালিনী

গ। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের সাধীমাধী

হেতুবতীর প্রাথমিক পরিচয় – “সে ছিল কুট্‌নীজাতীয়া চতুরা প্রধান।” ইবন সালাম নামে এক ধনীর পুত্রের সঙ্গে লায়লীর বিবাহ স্থির হয়। কিন্তু লায়লী এ বিবাহে মোটেও রাজি নয়। এমতাবস্থায় লায়লীর মাতা ডেকে আনে হেতুবতীকে। সে লায়লীকে ‘জীবন যৌবন রূপ নিশির স্বপন।’ কিংবা ‘জীবন যৌবন গেলে না আসিবে আর।’ – ইত্যাদি বলে লায়লীকে বিয়েতে রাজি করাতে চায়। কিন্তু তাতেও না হলে ষড়ঋতুর রসবৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে লায়লীর মধ্যে কামভাব জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। 

আরো পড়ুন :  ব্রজবুলি, উৎপত্তি, আদিকবি, পদরচয়িতা

‘হেতুবতীর সংকল্প’ /‘লায়লীকে যৌবন-চেতনা দানে হেতুবতীর চেষ্টা’ / ‘লায়লী-হেতুবতী সংবাদ’ / ‘হেতুবতীর ব্যর্থতা’ – ইত্যাদি অংশগুলিতে হেতুবতীর চরিত্র সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা লাভ করা যায়। আসলে সে ‘জান এ বহুল সন্ধি অনেক বন্দান।’ যদিও শেষ পর্যন্ত হেতুবতীর দৌত্য বিফলে যায়। পাশাপাশি ‘সতীময়না’ কাব্যের রত্নামালিনী অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত। তার ইতরতার উদ্দেশ্যও নীচুস্তরের।

“মধুরস স্থল তুণ্ড/

 হৃদয় গরল কুণ্ড/

 কপট মন্ত্রণা দমনক।”

কামনাকাতর ছাতনকুমারের দৌত্যের ভূমিকায় তার আবির্ভাব। রত্নামালিনী স্থূল রুচির তাই তার ইতরতায় পাঠকরা শিহরিত হয়। ময়নার সমগ্র বারমাস্যা জুড়ে সে ব্যাপৃত থাকে কীভাবে সতী স্ত্রী ময়নাকে কামনার পাঁকে টেনে নামানো যায়। যদিও ময়নার প্রবল সতীত্বের কাছে রত্নাকে হার স্বীকার করতে হয়েছে। এদিক থেকে হেতুবতী ও রত্নামালিনীকে একই পর্যায়ে ফেলা যায়।

অন্নদামঙ্গল-এ (‘মানসিংহ’ অংশ) ভবানন্দ মজুমদারের দুই স্ত্রী চন্দ্রমুখী ও পদ্মমুখী। স্বাভাবিকভাবেই দুই সতীনের কলহ অবশ্যম্ভাবী। এক্ষেত্রে ইন্ধন জুগিয়েছে তাদেরই দাসী সাধী ও মাধী, এরা দুর্বলার সগোত্র। নিজ নিজ মালকিনকে উসকে দিতে এরা বেশ পটু। বড়ো রানিকে সাধী বলে –

“ছোটরে বলিবে লোকে মহারানী গো।

 তোমারে বলিবে বুড়া ঠাকুরানী গো।।”

পক্ষান্তরে মাধীর বাক্য –

“রাজপাট সব লবে/

 তোমার কি দশা হবে/

 আমার ভাবনা এই।”

— রঙ্গকটাক্ষে লঘু মেজাজে প্রতি ঘরে ঘরের চিত্র যেন কবি এক নিমেষে এঁকে ফেলেন।


তথ্যসূত্র :


১। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য(সম্পাঃ),শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৫শ সংস্করণ),দে’জ পাবলিশিং,২০১৫। পৃঃ ১১১

২। মদনমোহন গোস্বামী(সম্পাঃ),ভারতচন্দ্র, সাহিত্য অকাদেমি,১৯৬১। পৃঃ ১৬

৩। প্রমথনাথ বিশী, বাংলা সাহিত্যে নরনারী,জিজ্ঞাসা,১৩৬০। পৃঃ ১৮ 


গ্রন্থঋণ :

১। অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য (সম্পা:), শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমগ্র, দে’জ পাবলিশিং,২০১৪।

২। আহমদ শরীফ (সম্পা:), লায়লী মজনু (দৌলত উজীর বাহরাম খাঁ), নয়া উদ্যোগ সংস্করণ,২০১২।

৩। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য (সম্পা:), চণ্ডীমঙ্গল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়য়,১৯৬৬।

৪। মদনমোহন গোস্বামী (সম্পা:), ভারতচন্দ্র, সাহিত্য অকাদেমি,১৯৬১।


লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মেল করুন – [email protected]


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *