ব্রজবুলি – উৎপত্তি, পদরচয়িতা

ব্রজবুলি এক প্রকার কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা। বাংলায় বৈষ্ণব পদাবলির জনপ্রিয়তার মূলে এই ভাষার দান বর্ণনাতীত। মৈথিল ও বাংলা ভাষার ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্ট ব্রজবুলির মাদকতা পাঠক ও শ্রোতার মনকে শজেই কেড়ে নেয়। পঞ্চদশ শতকের কবি বিদ্যাপতি এক  কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষার প্রয়োজন অনুভব করে অবহট্ট ভাষায় পদ রচনা করেছিলেন।

বৈষ্ণব পদাবলির ইতিহাস খুব প্রাচীন।  ‘গাথা সত্তসই’ -এ রাধাকৃষ্ণের যে প্রেম-অনুরাগের চিত্র আছে, পদাবলির এটাই সম্ভবত প্রাচীন উৎস। তারপর দ্বাদশ শতকে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এ এবং পরবর্তীকালে বিদাপতি-চণ্ডীদাসের পদাবলিতে তা সার্থক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আধুনিক ভারতীয় ভাষায় বৈষ্ণবপদ রচনা করেন মিথিলার আর এক সভাকবি উমাপতি ওঝা – বিদ্যাপতির আবির্ভাবের ১২৫ বছর আগে। তবে ব্রজবুলি বিকাশের জন্য অপেক্ষা ছিল বিদ্যাপতির।

‘ব্রজবুলি’ নামটি আধুনিককালের দেওয়া। উনিশ শতকে ঈশ্বর গুপ্ত সর্বপ্রথম এই নাম ব্যবহার করেন। ব্রজবুলি ভাষার মাধুর্য্য লক্ষ করে মনে করা হল যে, বৃন্দাবনের গোপ-গোপীরা সম্ভবত এই ভাষায় কথা বলে। ব্রজের বুলি বলে এর নাম হল ব্রজবুলি। 

আরো পড়ুন :  প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে দূতী-সহচরী, সুখেন মণ্ডল

———————————

পড়ুন – ব্রজবুলির আদিকবি

———————————

ব্রজবুলির উৎপত্তি সম্পর্কে একটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে যে, বাংলায় বিদ্যাপতির পদের বিকৃত রূপই ব্রজবুলি। কিন্তু এ ধারণার কোনও যৌক্তিকতা নেই। কারণ তাহলে এই বিকৃত ভাষা একটি সাহিত্যিক উপভাষারূপে সারা উত্তরভারতে বিস্তৃতি ও সমাদর লাভ  করতে পারত না। সুকুমার সেন এই মতের খণ্ডন করেছেন দুটি কারণে –

১] বিদ্যাপতির সময়ে মৈথিলী ভাষার সঙ্গে ব্রজবুলির যেমন সাদৃশ্যও রয়েছে তেমন রয়েছে বৈসাদৃশ্য।

২] বাংলা-মিথিলায় ছাত্রদের যাতায়াত ও দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার ফলে মৈথিলি ভাষার ঠাট নিয়ে অল্পকিছু দিনের মধ্যে বাংলায় একটি নতুন কাব্যধারার সৃষ্টি হলো – এ ধারণাও সত্য নয়। 

সুকুমার সেনের বক্তব্য হল –

সংস্কৃতে  ও প্রাকৃতে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কবিতা খ্রীষ্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত আর্যাবতের সর্বত্র প্রচারিত ছিল, বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলে। এই চার-পাঁচ শ বছর ধরে আর্যাবর্তে …… একটি সাহিত্যিক ভাষা প্রচলিত হয়েছিল। …. বৈষ্ণব পদাবলীর অপেক্ষাকৃত পূর্বতন রূপ বিদ্যমান ছিল অবহট্‌ঠ–এ অনুমান অপরিহার্য।… এই অবহট্‌ঠ থেকেই ব্রজবুলির উৎপত্তি হয়েছে।

(বিচিত্র সাহিত্য / ৫৮, ৬০)

বাংলাদেশে সুলতান হোসেন শাহের আমলে যশোরাজ খান প্রথম ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেন। পদটি হল– ‘এক পয়োধর চন্দন লেপিত আর সহজই গোর’– ইত্যাদি । উড়িষ্যায় এই ভাষায় প্রথম পদ রচনা করেছেন মহাপ্রভুর ঘনিষ্ট রায় রামানন্দ। মিথিলায় ব্রজবুলিতে প্রথম লেখার কৃতিত্ব উমাপতি ওঝার। আসামে শঙ্করদেব – যিনি উমাপতি ওঝার ‘পারিজাত হরণ’ অনুসরণে একই নামে নাটক লেখেন।

আরো পড়ুন :  সাল-তারিখে চৈতন্যের জীবনপঞ্জি

সুকুমার সেন সিদ্ধান্ত করেছেন : ব্রজবুলির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল নেপালে তীরহুত মোরঙ্গের রাজসভায়। কারণ তুর্কি আক্রমণের ফলে নেপালে বিহার ও বাংলাদেশের বহু পন্ডিত আশ্রয় নেন। নেপালে ব্রজবুলি পদাবলীর চর্চা অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত চলেছিল। শুধু তাই নয়, নেপালের রাজারাও এই ভাষায় পদ রচনা করতেন। 

বাংলাতে পাওয়া এ পর্যন্ত প্রথম পদটি পঞ্চদশ শতকের। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে অজস্র বৈষ্ণব কবি ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন গোবিন্দদাস। এই ব্রজবুলি ধারার শেষ পরিণতি উনবিংশ শতাব্দীতে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী‘।

আরো পড়ুন :  ব্রজবুলি সাহিত্যের আদি কবি

[ব্রজবুলি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন,  কালিদাস রায়, সতীশচন্দ্র রায় প্রমুখ।] 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *