জাল বর্ণপরিচয়

বর্ণপরিচয়ের নামে জালিয়াতি, জাল বর্ণপরিচয়

ঈশ্বরের নামে জালিয়াতি

লেখক – আবীর কর

আঠারোশো পঞ্চান্ন সালে প্রকাশিত হয়েছিল বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, বাংলা প্রাইমারের এক মাইলস্টোন। এই মাইলস্টোনকে নির্ভর করে আজ  দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে বাঙালি বর্ণশিক্ষা। শুধু তাই নয়, ১৮৫৫-পরবর্তী বাংলা প্রাইমারের ধারাটিও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর মাধ্যমে; বিদ্যাসাগরের হাতে গড়া বাংলা বর্ণমালার ব্যাকরণসম্মত সংস্কার—অসংযুক্ত পাঠ ও সংযুক্ত পাঠকে দুটি ভাগে ভাগ করা, আজও  অনুসৃত হয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, এই দেড়শো বছরে ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থের বিপুল জনপ্রিয়তায় আকৃষ্ট হয়ে অসংখ্য বাংলা প্রাইমারে জুড়ে গেছে ‘বর্ণপরিচয়’ শব্দটি। ‘সহজ’, ‘সরল’, ‘সুবোধ’, ‘সচিত্র’— বিশেষণ যোগে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হল, নামের পূর্বে যুক্ত হল ‘নব’, ‘নতুন’, ‘প্রথম’ ইত্যাদি শব্দ। এমনকী ‘বর্ণপরিচয়’ নামের বই লিখলেন অজস্র প্রাইমার রচয়িতা।

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়
বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। ৫৩তম সংস্করণ

কিন্তু ‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রভাব বা তার অনুকরণে প্রকাশিত প্রাইমারের মাঝে, আরও  এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল, ‘বর্ণপরিচয়’-এর নকল গ্রন্থ প্রকাশিত হল। বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থের হুবহু কপি বেরিয়ে পড়ল। নকল বর্ণপরিচয়। এই নকলনবিশির সুচনা বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই। তৎকালীন ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকার (৩০ অগ্রহায়ণ ১২৯৬ তারিখে) বিশেষ সন্ধানে ধরা পড়েছিল এক ‘জুয়াচোর গ্রন্থকারের’ বর্ণনা। পত্রিকার বয়ানে লেখা হয়েছে—

“শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বর্ণপরিচয়’ বহুসংখ্যক বিক্রীত হয়। জুয়াচোর গ্রন্থকারও বর্ণপরিচয় ছাপাইল। মলাটে লেখা হইল–

বর্ণপরিচয়

প্রথম ভাগ

শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মহাশয়ের চরণকমল স্মরণ করিয়া প্রণীত


‘মহাশয়ের চরণকমলটি’ অতি ক্ষুদ্র অক্ষরে মুদ্রিত। এমনকী অণুবীক্ষণ লইয়া দেখিতে হয়। অবোধ পাঠক বুঝে, এ গ্রন্থ বুঝি স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্ত্তৃক রচিত।”

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের এই জুয়াচুরি প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের কোনও মন্তব্য আমরা পাইনি। বিদ্যাসাগর প্রয়াত হলেন ১৮৯১-তে৷৷

বিদ্যাসাগর তাঁর জীবদ্দশায়, ১৮৭৬ সালে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের ষাটতম সংস্করণ এবং ‘বর্ণপরিচয়’ দ্বিতীয় ভাগের বাষট্টিতম সংস্করণে তাঁর গ্রন্থদ্বয়ের বিন্যাসে শেষবারের মতো সংস্কার করেন।

প্রথমভাগের ষাটতম সংস্করণ ‘স্বরে অ, স্বরে আ’’ পাঠে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, এবং (খণ্ড ত’কার) ‘ৎ’ বর্ণকে বাংলা বর্ণমালায় অনুমোদন দেন। দ্বিতীয় ভাগের বাষট্টিতম সংস্করণে পাঠের আংশিক পরিবর্তন ঘটে, চারটে নতুন পাঠ সংযোজিত হয় এবং গ্রন্থশেষে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’’ স্বরূপ বন্ধুবর মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’ থেকে যে ‘প্রভাত বর্ণন’ কবিতাটি সংযুক্ত ছিল, তা ‘নিষ্কাশিত’ করেন। এরপর ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের ষাটতম সংস্করণ এবং দ্বিতীয় ভাগের ‘বাষট্টিতম’ সংস্করণটিরই পুনর্মুদ্রণ ছাপা হয়েছে বিদ্যাসাগরের প্রয়াণকাল অবধি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নারায়ণ আদালতের শরণাপন্ন হলেন, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের বলে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের পাঠ্যপুস্তকের স্বত্বাধিকার সহ ঈশ্বরচন্দ্রের সব সম্পত্তি দখলে আনলেন। ‘যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী’ নারায়ণ, বিদ্যাসাগর যাঁকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিলেন, ১৮৯৫/৯৬ সাল নাগাদ ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থদ্বয়ে তাঁরই হস্তক্ষেপ ঘটল। হয়তো সময়ের দাবি মেনেই বিদ্যাসাগর-পুত্র ‘বিদ্যারত্ন’ বর্ণশিক্ষার গ্রন্থে নানা পরিবর্তন আনলেন। অক্ষর পরিচয়ে, সংশ্লিষ্ট অক্ষর-যোগে শব্দ ও ছবির অনুপ্রবেশ ঘটালেন। বিদ্যাসাগর কৃত সারিবদ্ধ অ, আ, ক, খ নবপরিচয়ে হল অ-অজগর, আ-আনারস, ক-কোকিল,খ-খরগোশ প্রতিটি শব্দের সাদাকালো সচিত্র পরিচয়। বিদ্যাসাগর তাঁর সমকালে অন্যান্য সচিত্র প্রাইমার গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘বর্ণপরিচয়’কে চিত্র ভূষিত করেননি। সেটা করলেন নারায়ণ।

আরো পড়ুন :  মধুসূদনের 'হেক্টরবধ' কাব্য সম্বন্ধে দু-চার কথা

শুধু তাই নয়, ‘বর্ণযোজনা’র দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’-এ যেসব বানান নির্দিষ্ট করেছিলেন, নারায়ণ বানান-তালিকা থেকে সেগুলি যথেচ্ছ খারিজ করলেন, নতুন বানানের অনুপ্রবেশ ঘটালেন, বদল আনলেন বাক্যবন্ধেও। নমুনা হিসেবে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের একাদশতম সংস্করণ, তিপ্লান্নতম সংস্করণ এবং পরবর্তীকালে নারায়ণ-কৃত সংস্করণের ‘বর্ণযোজনা’ এবং ‘পাঠ’ দেখলেই ‘বর্ণপরিচয়’-এর বিবর্তন তথা পরিবর্তনের পরিচয় মিলবে—

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়

(মূলত নারায়ণ বিদ্যাসাগরের দেওয়া দীর্ঘ বানান-তালিকাকে সংক্ষিপ্ত করেছেন। নতুন বানানের আমদানি তুলনায় কম।)

বাক্যপাঠেও ঘটেছে অল্পবিস্তর প্রভেদ—

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়

‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের পাঠ বদল চিত্রে, ‘গোপাল-রাখাল’ পাঠ-বদলটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। প্রথমত ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের একাদশতম সংস্করণে গোপাল ও রাখালের আখ্যান অনুপস্থিত, অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাগের অষ্টম সংস্করণে উক্ত আখ্যানদ্বয় সংযুক্ত হয়েছে, সেখানেও পাঠ-বদল যথেষ্ট। নমুনা—

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়

নারায়ণ অবশ্য গোপাল-রাখাল আখ্যানে উল্লেখযোগ্য বদল আনেননি, প্রায় বিদ্যাসাগর প্রদত্ত পাঠকেই অনুসরণ করেছেন। এমনকী দ্বিতীয় ভাগে সংযুক্ত ‘যাদব’ ‘নবীন’, ‘মাধব’, ‘রাম’ এবং পরিশেষে ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’  শিরোনামে পরিচিত ভুবন ও তার মাসির নীতিগল্পকে অটুট রেখেছেন।

কিন্তু খুব বেশিদিন তাঁর দখলেও বর্ণপরিচয়ের স্বত্বাধিকার থাকল না। বিদ্যাসাগরের উইল অনুযায়ী বহু ব্যক্তি বৃত্তি পেতেন। নারায়ণ তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই বৃত্তিভোগীরা এবার আদালতের দ্বারস্থ হলেন। আদালতের নির্দেশ এল, বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি বন্ধক রেখে, বৃত্তি বা মাসোহারাভোগীদের টাকা মিটিয়ে দিতে। সেই মতো রিসিভার নিযুক্ত হন হাইকোর্টের অ্যাটর্নি জ্যোতিষচন্দ্র মিত্র, পরবর্তীকালে রিসিভার হন ব্যারিস্টার প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী। বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি হিসেবে বন্ধক রাখা হল তার বাদুড়বাগানের বাড়িটি এবং তাঁর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’ সহ অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকগুলি। এভাবে কিছুদিন বৃত্তিভোগীরা তাঁদের প্রাপ্য অর্থ পেলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একদিন বন্ধক রাখা সম্পত্তি ছাড়ানোর মেয়াদও যখন উত্তীর্ণ হয়ে গেল,পাঠ্যপুস্তকগুলির স্বত্ব বিক্রির জন্য ডাকা হল নিলাম। সেখানে সর্বোচ্চ দর দিয়ে বইগুলির স্বত্ব অধিকার করেন আশুতোষ দেব, যিনি এ টি দেব নামে অধিক পরিচিত। ততদিনে বিদ্যাসাগর-পুত্র নারায়ণ বিদ্যারত্ন-কৃত ‘বর্ণপরিচয়’ সর্বসাধারণের মান্যতা লাভ করেছে, ফলে ‘বর্ণপরিচয়’-এর রিসিভার সংস্করণ এবং পরবর্তীকালে এ টি দেবের তত্ত্বাবধানে, দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত ‘বর্ণপরিচয়’ আসলে যতখানি না ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, তার চেয়ে বেশি নারায়ণ বিদ্যারত্নের ‘বর্ণপরিচয়’। মনে রাখতে হবে, ওই পরিবর্তিত ‘বর্ণপরিচয়’ আজকের প্রচলিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’।

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়
জাল ‘বর্ণপরিচয়’

অন্যদিকে গ্রন্থস্বত্বের নিয়মানুযায়ী, এ টি দেবের স্বত্বাধিকারের মেয়াদ ফুরোলে যে-কোনও প্রকাশন সংস্থাই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থ প্রকাশ করার যথেচ্ছ স্বাধীনতা পেয়ে যান। প্রকাশিত হয় ‘বর্ণপরিচয়’-এর নির্মল সংস্করণ, নন্দন সংস্করণ, সংসদ সংস্করণ। এছাড়াও নানা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থ। প্রকাশনা সংস্থার রুচি অনুযায়ী সেগুলি সেজে উঠছে, আধুনিক বানানবিধির দোহাই দিয়ে পুরনো বানানে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আবার তার সঙ্গে বেশ কিছু নতুন বানানের আমদানি ঘটছে। পাঠ শেষে সংযোজিত হচ্ছে প্রশ্ন ও অনুশীলনী। নারায়ণ বিদ্যারত্নের সময়ের সেই সাদা-কালো ছবির বদলে এখন রঙিন ছবির রমরমা। অ-এ অজগর থেকে শুরু করে গোপাল-রাখাল এবং দ্বিতীয় ভাগের ভুবন ও তার কুখ্যাত মাসি– সবাই এখন রঙিন, চটকদার।

আরো পড়ুন :  নিরুদ্দেশের কাহিনী (‘পলাতক তুফান’) / জগদীশচন্দ্র বসু

পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় যে ‘জাল বর্ণপরিচয়’-এর সন্ধান দিয়েছিল ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা, আজ  সে জাল আরও  বিস্তৃত ও সুদুরপ্রসারী। বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকাকালীন যদি জুয়াচোরেরা তাঁর গ্রন্থের হুবহু কপি করে, তাঁর নাম ও ছবি ব্যবহার করে লোক ঠকাতে পারে, তাহলে আজকের দিনে সেই চৌর্যবৃত্তির রমরমা হওয়াই স্বাভাবিক। ‘বর্ণপরিচয়’ আজ অভিভাবকহীন, স্বত্বহীন। তাই জালগ্রন্থের অসাধু ব্যবসায়ীরা দিব্যি বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’কে অবিকল নিজের নামে বা একটু-আধটু নিয়মরক্ষার হেরফের ঘটিয়ে ঢালাও ব্যবসা করে চলেছেন। বাংলা বই-বাজারের নিয়মকানুন তাদের ছোঁয় না বা ছুঁতে পারে না। গ্রন্থস্বত্বের মেয়াদ শেষ হলে কোন লেখকের লেখা যে-কোনও প্রকাশক ছাপতে পারেন, কিন্তু তাই বলে সে লেখা কি কেউ নিজের নামে ছাপাতে পারেন ? ছাপাখানার নিয়ম বা গ্রন্থস্বত্বনীতি যাই হোক, এটি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা বোধ করি কোনও প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না। তাই বিদ্যাসাগরের নাম ভাঁড়িয়ে লেখা শ্রীঅমুকচন্দ্র অমুকও লেখক শিরোপা পান। জাল বর্ণপরিচয় বেচে দিব্যি বেঁচে থাকেন। হয়তোবা পাড়া-প্রতিবেশীর সম্ভ্রমও আদায় করে নেন।

‘আসল বর্ণপরিচয়’ ও ‘নকল বর্ণপরিচয়’-এর পাঠ বদল প্রত্যক্ষ করলে পাঠক তার প্রমাণ পাবেন।

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়

মিল-অমিলের চিত্রটি কৌতুককর। তবে এই মিল-অমিল তথা গোঁজামিলের চিত্র শুধু বানান বা বাক্য বদলে সীমাবদ্ধ নয়। দ্বিতীয় ভাগে আসল  ‘যাদব’ হারিয়ে গিয়ে নকল ‘নবীন’-এর প্রবেশ ঘটেছে। ‘মাধব’-এর গল্প এসেছে ‘রাখাল’-এর নামে। সর্বোপরি বিদ্যাসাগরের ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’ গল্পের ‘ভুবন’, জাল বর্ণপরিচয়’-এ নাম ভাড়িয়ে হয়েছে ‘বেণী’, সমগ্র পাঠ-বিন্যাসটি যদিও বিদ্যাসাগরের।

জাল ‘বর্ণপরিচয়’-এর লেখকরা মদনমোহন তর্কালঙ্কারকেও  রেয়াত করেননি। ‘শিশুশিক্ষা’ প্রথম ভাগের ‘প্রভাত বর্ণন’ কবিতাটি (পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল) বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়/দ্বিতীয় ভাগের পরিসমাপ্তিতে একসময় সংযোজিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর দ্বিতীয় ভাগের বাষট্টিতম সংস্করণে কবিতাটিকে বাদ দেন। জাল গ্রন্থের কারবারিরা সেই পরিবর্তিত সংস্করণকে আমল দেননি, তাঁরা জনপ্রিয় কবিতাটিকে প্রথমভাগের শেষে জুড়ে দিয়েছেন, প্রকৃত কবি-পরিচয় ছাড়াই। পরিণাম ভয়ংকর। শিশু শিক্ষার্থী তথা সাধারণ পাঠকের মনে হবে ‘প্রভাত বর্ণন’ কবিতাটি হয় বিদ্যাসাগর নতুবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পথাবলম্বনে ‘দেবদাস’, ‘কালি দাস’ প্রমুখ নামধারী লেখকের। আরও চাঞ্চল্যকর বিষয়, শুধু ‘প্রভাত বর্ণন’ কবিতাটি নয়, ‘জাল বর্ণপরিচয়’-এর দ্বিতীয় ভাগে ‘ফলা শিক্ষণ’ বা যুগ্ম ব্যঞ্জনের শিক্ষণে যে-বাক্য পাঠ আছে, তার অধিকাংশই হুবহু মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’ দ্বিতীয় ভাগ থেকে অপহৃত। বইয়ের মলাটে বিদ্যাসাগরের নাম ও ছবি থাকলেও গ্রন্থমধ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কোনও রূপ নামগন্ধ নেই। অথচ ‘বর্ণপরিচয়’ জাল গ্রন্থের লেখক তথা ‘কালি দাস’-এর দল নির্দ্বিধায় অসংখ্য বাক্য ‘শিশুশিক্ষা’ থেকে হরণ করে পাঠ নির্মাণ করেছেন। রাশি রাশি দৃষ্টান্ত থেকে অন্তত দুটি উল্লেখ মানানসই হবে : ‘মূর্খের অশেষ দোষ’, ‘মূঢ়ের দিগ্বিদিক বোধ নাই’।

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়
৬২তম সংস্করণ

গ্রন্থ রচনার ভুবনে যশোলিন্সার প্রবল আকাঙ্ক্ষা কুম্ভীলকবৃত্তি কোনও নতুন বিষয় নয়। বড় নামজাদা লেখকের রচনার অংশবিশেষ নিজের নামে চালানো, একজনের গবেষণাপত্র থেকে আর একজনের ফরদাফাই করে নেওয়া– এ খবরও এখন ক্লিশে। এমনকী, গবেষক-ছাত্রের মৌলিক ভাবনা-ঋদ্ধ রচনা শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই আত্মসাৎ করেন, যেখানে প্রবল অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে সারস্বত-চৌর্যচর্চার ‘পরম্পরা’টিও ভেঙে পড়ে। এছাড়াও আর-এক ধরনের জাল-রচনার কথা শোনা যায়। বড় লেখকদের নামে মাঝারি বা ছোট মানের নামহীন লেখকরা তাঁদের রচনা চালিয়ে দেন, সম্পূর্ণ নামহীন নিজেকে আড়ালে রেখে। এর জন্য যদিও অনুকরণ ক্ষমতার প্রয়োজন আছে, অনেকটা সংগীতের বাজারে ‘কণ্ঠী’ শিল্পীর মতো বা কাজটা তার চেয়েও কঠিন। কিন্তু ‘কঠোর বিকল্পের কোনও পরিশ্রম নেই’। ‘জাল বর্ণপরিচয়’ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কয়েকটি বানানের নমুনা পালটে, পাঠের একটু ইতর-বিশেষ ঘটিয়ে যদি গ্রন্থরচনাকার তথা লেখকের মর্যাদা মেলে ক্ষতি কী ? আজও  গ্রামে-গঞ্জে-মফস্সলে এই ‘জাল বর্ণপরিচয়’-এর রমরমা চলছে। বিশেষত, গ্রামেগঞ্জে মুদির দোকান থেকে যে-‘বর্ণপরিচয়’ মেলে, সে সবের প্রায় সম্পূর্ণটাই জাল বর্ণপরিচয়। তেল নুনের সঙ্গে সহবাস করা জাল বর্ণপরিচয়– এই জালগ্রন্থগুলিতে যথারীতি বড় হরফে ‘বর্ণপরিচয়, প্রথম ভাগ/ দ্বিতীয় ভাগ’, তলায় বড় হরফে মুদ্রিত ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’। এরপর ছোট অক্ষরে লেখা ‘মহাশয়ের পথাবলম্বনে/পন্থানুসারে’। এরপর লেখক-নাম। তবে লেখক-নামটি আর ঈশ্বরচন্দ্রের সমকালে ‘অনুসন্ধান’-এ মেলা জুয়াচোর গ্রন্থকারের ন্যায় ‘অতি ক্ষুদ্র অক্ষরে মুদ্রিত’ নয়, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কোনও প্রয়োজনই নেই। বোধহয় আজকের জুয়াচোরেরা অকুতোভয়,কেননা দিব্যি চর্মচক্ষে দেখা যাবে প্রায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমানাকৃতি অক্ষরে মুদ্রিত অমুকচন্দ্র অমুক। এমনকী, মলাট পাতায় ছাপাখানার ঠিকানা সমুদ্রিত, দাম দশ টাকা। আর অতি অবশ্যই গোলাপি মলাটের মধ্যিখানে ছাপা ঈশ্বরচন্দ্রের সাবেকি ছবিটি। তবে শুধু ‘বর্ণপরিচয়’ নয়, বর্ণবোধ, ধারাপাত, বাংলা বানানের নানা বই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর মুখোশে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। সেসব বইও গোলাপি মলাট দেওয়া, বিদ্যাসাগরের ছবি যুক্ত।

আরো পড়ুন :  রবীন্দ্রনাথের বাংলা নাটকের ইংরাজি অনুবাদ, রবীন্দ্র-কৃত

ঈশ্বরচন্দ্রের নাম ভাঁড়িয়ে, ‘বর্ণপরিচয়’ জালগ্রন্থে আজ  শিশুপাঠ্যের বাজার ছেয়ে গেছে। যুগোত্তীর্ণ একটি শিশুশিক্ষার গ্রন্থ, যার রচয়িতা বাংলা ভাষা ও শিক্ষা বিস্তারে তথা বাঙালির বাংলা শিক্ষারম্ভের এক মহতী ব্যক্তিত্ব, তাঁর নিকৃষ্ট নকল বা তাঁর চিত্র ও স্বাক্ষর দর্শিয়ে লোক ঠকানোর এই অসাধু ব্যবসা কি চলতেই থাকবে ?

ঈশ্বরের নামে এই জালিয়াতির বিধান হয়তো আমরা আর  একজন ঈশ্বরের কাছে চাইতাম, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব নিয়েই আছে সংশয়। আর সংশয়হীন, নিশ্চিত ঈশ্বর নামে যিনি ছিলেন, সেই ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আজ  থেকে ১২৬ বছর [২০১৭ খ্রি.-এর হিসাবে] আগেই আমাদের ছেড়ে গেছেন।

বিদ্যাসাগর vidyasagar বর্ণপরিচয়
সচিত্র বর্ণপরিচয়। ৬২তম সংস্করণ


সহায়ক তথ্যসূত্র :

  • সংবাদ-সাময়িক পত্রে বিদ্যাসাগর (১৮৫১-১৮৯৩), স্বপন বসু, আকাদেমি পত্রিকা, মে ১৯৯৪
  • বর্ণপরিচয়ের দেড়শো বছর, অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৪১২।
  • বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ (১৮১৬-১৮৫৫), সম্পাদনা: আশিস খাস্তগীর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৬।
  • শিক্ষাসংস্কারে বিদ্যাসাগর ও বর্ণপরিচয়, বিনয়ভূষণ রায়, ১৯৮১।
  • বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড : শিক্ষা, প্রধান সম্পাদক- শ্রী গোপাল হালদার, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭৬।
  • জাল বর্ণপরিচয়, প্রথম ভাগ/দ্বিতীয় ভাগ– ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পথাবলম্বনে
  • দেবদাস ভট্টাচার্য প্রণীত, অন্নপূর্ণা লাইব্রেরী, হাওড়া
  • শ্রীকান্ত দেবরায় প্রণীত, সরস্বতী লাইব্রেরী, শোভাবাজার
  • কালি দাস প্রণীত, সরস্বতী বুক এজেন্সি, হাওড়া।


প্রকাশ - বইয়ের দেশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *