চৈতন্য জীবনী

সংক্ষেপে চৈতন্য-জীবনীর নানাদিক

বাংলায় চৈতন্যদেবের জীবনী নিয়ে গ্রন্থের অভাব নেই। বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর বহুমাত্রিক জীবনের নানা দিক তুলে ধরবার চেষ্টা হয়েছে। চৈতন্য-ভক্তের জীবনী-কাব্যের কথা বলছি না, বলছি পাথুরে প্রমাণে বিশ্বাসী ইতিহাসের গবেষকদের গ্রন্থের কথা। যাঁরা শ্রীচৈতন্যের জীবনকে বোঝার চেষ্টা করেছেন সেইসব জীবনী গ্রন্থ রচনার মধ্যে দিয়ে। চৈতন্যদেবের জীবনী রচনার শুরু অনেক আগেই, সেই মধুযুগে, তাঁর ভক্তবৃন্দের কলমে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই জানেন সেইসব জীবনী-সাহিত্যের কথা। এখানে তার উল্লেখ করব না। এখানে উল্লিখিত হবে এমন সেই গ্রন্থের, যে গ্রন্থে চৈতন্যের  জীবনের নানা ঘটনাকে যথাসম্ভব সঠিক কালের আগড়ে বাঁধতে। 

গ্রন্থকার সুখময় মূখোপাধ্যায়কে চেনেন অনেকেই, তাঁর “বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর : স্বাধীন সুলতানের আমল (১৩৩৮ – ১৫৩৮ খ্রি.)” বইটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এছাড়া প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কালক্রম নিইয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই রয়েছে। এই বইটিও সেই পর্যায়ে পড়ে। “চৈতন্যদেব জীবনী কালক্রম পরিমণ্ডল প্রিয়মণ্ডল” –ভূমিকাসহ ১২৬ পাতার এই বইটি যেন একটি গবেষণাপত্র অথচ সুপাঠ্য।

চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পাঁচশতবছর উপলক্ষে এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। অর্থাৎ সম্ভবত  এটি গ্রন্থের ২য় সংস্করণ, ৩৬-৩৭ বছরের ব্যবধান। বইটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য :

এই বইটির মধ্যে চৈতন্যদেব ও তাঁর বিভিন্ন পরিকর সম্বন্ধে আমার [অর্থাৎ লেখকের] সমস্ত গবেষণা একত্রে পাওয়া যাবে।

(ভূমিকা অংশ)

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে চৈতন্যদেবকে একজন ইতিহাসের প্রধান পুরুষ হিসেবে গবেষকের জীবনী জাতীয় রচনা হলো এটি। ভুমিকাতেই লেখক অনেক কথা জানিয়েছেন, তাঁর গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য, পূর্বে কী কী লেখা রয়েছে, সেই লেখা সম্পর্কে লেখকের মতামত সমস্ত কিছু। লেখক কিছু রাখঢাক করেননি। স্পষ্টভাবেই অসত্য তথ্যে বিরোধিতা করেছেন, তা সে প্রতিপক্ষ সুকুমার সেন হোক না কেন,

ডক্টর সুকুমার সেনের গবেষণায় পাণ্ডিত্যের নিদর্শন যতটা মেলে , সাবধানতার নিদর্শন ততখানি মেলে না। তিনি অন্য গবেষকের লেখা পড়েননা বলেও তাঁর গবেষণায় ত্রুটি থেকে যায়।

(ভূমিকা অংশ)

ঐতিহাসিক চৈতন্যদেবের পরিচয়কে তথ্য ও প্রমাণের মধ্যে দিয়ে সকলের সামনে তুলে ধরবার প্র্যাস শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ থেকে। রচিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে বিমানবিহারী মজুমদারের “শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান” গ্রন্থখানি অনেক দোষত্রুটি মুক্ত। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের লেখাকে ভক্তের দৃষ্টিকোণে লেখা বলেছেন সুখময় মুখোপাধায়। এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে লেখক চৈতন্যের জীবনকে সরল্ভাবে উপস্থাপিত করেছেন।

আরো পড়ুন :  চৈতন্যদেবের জীবনের কালপঞ্জি

সমস্ত গ্রন্থটি ৬টি পরিচ্ছেদ ও ২টি পরিশিষ্ট  সম্বলিত। প্রথম পরিচ্ছেদ “চৈতন্যদেবের জীবনী”। খুব সংক্ষেপে চৈতন্যদেবের জীবনী এখানে বর্ণনা করেছেন গ্রন্থকার। কেননা চৈতন্যের জীবনীর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত বলে এমন সিদ্ধান্ত। চৈতন্যের মৃত্যুর বিষয়ে জয়ানন্দের কাব্য-এ বর্ণিত কারণকেই লেখক উল্লেখ করেছেন–রথ-বিজয়ার দিন চৈতন্যদেবের পায়ে ইটের আঘাতে তীব্র বেদনা শুরু হয় আর সে কারণেই তাঁর দেহান্ত হয়।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ সবথেকে চমকপ্রদ এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই অংশটি হুবহু লেখকের “মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম” থেকে নেওয়া। “চৈতন্য-জীবনীর কালক্রম” নামাঙ্কিত পরিচ্ছেদে চৈতন্যদেবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে কালক্রমে সাজানো হয়েছে। প্রতি ঘটনার সাপেক্ষে রয়েছে উপযুক্ত প্রমাণপঞ্জি। শুধুমাত্র এই অধ্যায়টির জন্যেও বইটি কিনে ফেলা যায়। বিভিন্ন চরিতসাহিত্য, অন্যন্য প্রমাণপঞ্জি এবং জ্যোতিষ গণনার সাহায্যে এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন লেখক। এটি খুব শ্রমসাধ্য এবং সুতীক্ষ্ণ যুক্তিবোধের পরিচায়ক।

আরো পড়ুন :  মুকুন্দ না মুকুন্দরাম নাম বিভ্রাট

তৃতীয় পরিচ্ছেদে শ্রীচৈতন্যের শিক্ষাষ্টকের ব্যাখ্যা আলোচনা রয়েছে। অনেকেই জানেন যে, শ্রীচৈতন্যের লেখা বলতে অবশিষ্ট যা রয়েছে তা হলো ৮টি শ্লোক মাত্র। তবে ন্যায়শাত্রের টীকা জলে ফেলে দিয়েছিলেন বলে যে কিংবদন্তি রয়েছে তা লেখকের মতে অমুলক।

সর্বশেষ পরিচ্ছেদ “চৈতন্যদেবের পরিকরবৃন্দ”। এই অংশে ১৬ জন পরিকরের বৃত্তান্ত লেখক সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। এই আলোচনা আরো একটু দীর্ঘ হলে ভালো হত। শ্রীনিবাস আচার্য চৈতন্যের সান্নিধ্য লাভ না করলেও তাঁকে এই অংশে স্থান দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে নিয়েই তিনটি লেখা এখানে রয়েছে।

দুটি পরিশিষ্টের সংযোজন গ্রন্থখানির মর্যাদা আরও বাড়িয়েছে বলে মনে করা যায়। ১৯৫৫ খ্রি. প্রকাশিত অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের দুস্প্রাপ্য “শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মকুণ্ডলী” প্রবন্ধটি পরিশিষ্টে সংযোজিত হয়েছে।

আরো পড়ুন :  বৈষ্ণব সাহিত্যে অষ্টকালীন নিত্যলীলা, প্রীতম চক্রবর্তী

সুপাঠ্য এই বইটি দীর্ঘদিন অমুদ্রিত ছিল। এই বইটি প্রকাশ করে প্রকাশক আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। বইটি পড়ুন যারা ইতিহাসের তথ্য চান তাঁরা নিরাশ হবেননা। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে গ্রন্থটি রচিত। কোনোরকম ভাবালুতার লেশমাত্র নেই। বিশ্বভারতীর এই অধ্যাপকের অন্য বই যারা পড়েছেন তাঁরা মাত্রই জানেন। বইটিকে এমনভাবে সজ্জিত যে একদিনেই বইটিকে পড়ে ফেলা যায়। অক্ষরবিন্যাস, পৃষ্ঠা ভালোমানের। মূল্য কিছুটা কম হলে ভাল হত, তবে বই প্রকাশের খরচ দিন দিন খুব বেড়ে চলেছে, যার কারণে এই মূল্যবৃদ্ধি।

  • ১। চৈতন্যদেবের জীবনী
  • ২। চৈতন্য-জীবনীর কালক্রম
  • ৩। লেখক চৈতন্যদেব
  • ৪। চৈতন্যদেবের সাধনা
  • ৫। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পটভূমি
  • ৬। চৈতন্যদেবের পরিকরবৃন্দ–
  • অদ্বৈত
  • হরিদাস
  • নিত্যানন্দ
  • গদাধর পণ্ডিত
  • নরহরি সরকার
  • রঘুনন্দন
  • বাসুদেব সার্বভৌম
  • স্বরূপ দামোদর
  • রূপ-সনাতন
  • জীব গোস্বামী
  • গোপাল ভট্ট
  • রঘুনাথদাস
  • রঘুনাথ ভট্ট
  • মুরারি গুপ্ত
  • কবিকর্ণপূর
  • শ্রীনিবাস আচার্য
  • ৭। শ্রীনিবাসের প্রথম বৃন্দাবনে গমনের ও সনাতন রূপের তিরোভাবের সময়
  • শ্রীনিবাস আচার্যের রচনা
  • পরিশিষ্ট ১
  • পরিশিষ্ট ২


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *