নারী চরিত্র
১. রঞ্জাবতী :
রঞ্জাবতী ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান নারী চরিত্র। বৃদ্ধ রাজা কর্ণসেনের সঙ্গে রঞ্জাবতীর বিবাহ হয়েছিল। রঞ্জাবতীর পতিভক্তি বা দেবভক্তি মধ্যযুগের আরো পাঁচটি নারীচরিত্রের সমতুল্য। পুত্র কামনায় রঞ্জাবতী কঠোর সাধনা করেছে। দেবতার বরে রঞ্জাবতীর গর্ভে লাউসেনের জন্ম হয়েছে। রঞ্জাবতী সবসময় পুত্র লাউসেনকে মাতুল মাহুদ্যার হাত থেকে অতি যত্নে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
২. দুর্গা :
এই কাব্যে ‘আখড়া পালা’য় দুর্গাকে গণিকারূপে দেখা যায়। দেবী দুর্গা লাউসেনকে পরীক্ষা করবার জন্যে গণিকাদের মতো অনেক ছলাকলায় মোহিত করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরে লাউসেনের সংযমে দেবী খুশি হলেন। নিজ বেশে দেখা দিয়ে লাউসেনকে আশীর্বাদ করলেন এবং বর দিলেন।
৩. নয়ানী :
কাব্যটির ‘জামতি পালা’য় যে নারীটি প্রাধান্য পেয়েছে সে হল নয়ানী। নয়ানী জামতি নগরের এক গৃহবধূ। সে লাউসেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। লাউসেনকে বিভিন্ন ছলাকলায় ভোলাতে চেয়েছে। লাউসেনের প্রত্যাখানে মিথ্যা অভিযোগ করেছে রাজার কাছে। যদিও শেষপর্যন্ত নয়ানীর স্বরূপ সকলের সামনে প্রকট হয়ে পড়েছে। একটি খল কামুকা নারীর অসাধারণ চরিত্র হিসাবে নয়ানী উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র।
৪. সুরিক্ষা :
‘গোলাহাট পালা’য় সুরিক্ষার প্রসঙ্গ রয়েছে। সে একজন উল্লেখযোগ্য গণিকা। তার বুদ্ধি, চাতুর্যে, ছলাকলায় সে অনেক পুরুষকে মোহিত করেছে। লাউসেন-এর প্রতি সুরিক্ষাও তার ছলাকলা বিস্তার করেছে। লাউসেনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সুরিক্ষা পরাজিত হলেও সে গুণবতী ছিল। নয়ানীর তুলনায় সুরিক্ষা অধিক উজ্জ্বল।
৫. কলিঙ্গা :
লাউসেনের পাটরানী। যুদ্ধবিদ্যায় তার অসাধারণ দক্ষতা। মাহুদ্যা (মহামদ) ময়নাগড় আক্রমণ করলে কলিঙ্গা যুদ্ধযাত্রায় নেতৃত্ব দেয়। শত্রুসৈন্যর হাতে বন্দী হবার আগেই কলিঙ্গা আত্মহত্যা করে।
৬. কানড়া :
কানড়া রণরঙ্গিণী দুঃসাহসী যুবতী, লাউসেনের পত্নী। কানড়ার বীরত্বে ও প্রেমের গাঢ়তায় লাউসেন কানড়াকে বিবাহ করেছে। মহামদের সঙ্গে যুদ্ধে কানড়ার বীরত্ব দেখবার মত। এককথায় কানড়া উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র।
৭. লক্ষ্মী ডোমনী :
কালু ডোমের স্ত্রী। বীরাঙ্গনা নারী। ময়নাগড় রক্ষার দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে লক্ষ্মীর বীরত্ব স্বীকৃত হয়েছে। যুদ্ধে নিজের পুত্রদের পাঠাতেও দ্বিধা করেনি। এককথায় বীরত্বে, মাতার স্নেহে, পতিভক্তিতে লক্ষ্মী অসাধারণ চরিত্র।
অন্যান্য :
এছাড়া গণিকা সুরিক্ষার পরিচারিকা গুরিক্ষা, বৃদ্ধা বেশ্যা ভাজন বুড়ীর চরিত্র কাব্যে রয়েছে।
——————————————————————————–
পুরুষ চরিত্র
১. লাউসেন :
লাউসেন ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়ক। সে ধর্মঠাকুরের বরপুত্র, রঞ্জাবতী অনেক সাধনায় লাউসেনকে পেয়েছে। ধর্ম ঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট লাউসেন একের পর এক যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, মোহ মুক্ত হয়েছে। মামা মহামদের শত চেষ্টাতেও লাউসেন অক্ষত থেকেছে।
২. মহামদ (মাহুদ্যা) :
মহামদ এই কাব্যের নায়ক প্রতিরোধী শক্তি, বলতে গেলে ভিলেন। লাউসেনের সম্পর্কে সে মামা। গৌড় রাজার সেনাপতি সে। শেষে লাউসেনের নিকট মহামদের চুড়ান্ত পরাজয় ঘটে এবং ধর্মঠাকুরের অভিশাপে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়।
৩. গৌড় রাজ :
কাব্যে গৌড়রাজ বৃদ্ধ এবং ব্যাক্তিত্বহীন। প্রধান আমাত্য মহামদের পরামর্শে গৌড়রাজ সব কাজ করত। কর্ণসেনের সঙ্গে রঞ্জাবতীর বিবাহ দেওয়া ছাড়া গৌড়রাজের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব তার চরিত্রে অঙ্কিত হয় নি।
৪. কালুডোম :
কালুডোম লাউসেনের সেনাপতি। লাউসেন কালুকে সেনাপতি বানিয়ে ডোমদের নিয়ে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে। তার চরিত্রে রয়েছে বীরত্ব ও প্রভুভক্তি। এছাড়াও প্রতিজ্ঞা পালনে সে ছিল সত্যনিষ্ঠ। তাই মহামদের কাছে দেওয়া কথায় সে আত্মহত্যাও করেছিল।
৫. কর্ণসেন :
ইনি লাউসেনের পিতা, একজন সামন্ত। চরিত্রে তেমন কোনো ব্যাক্তিত্বের ছাপ নেই।
৬. কর্পূরধবল :
লাউসেনের ছোটো ভাই, ভীরু সহজ-সরল চরিত্র। দাদা লাউসেনের বিপরীতধর্মী চরিত্র।
৭. ইছাই ঘোষ :
মহামদের অনুসারী অর্থাৎ ভিলেন চরিত্র। গোপবংশ জাত, কিন্তু গপদের সংগঠিত করে সে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ইছাই ঘোষ লাউসেনের প্রকৃত প্রতিপক্ষ। সে মহাবীর সন্দেহ নেই। লাউসেনের কাছে তার পরাজয় হলেও কবিদের লেখায় তার মহিমা স্বল্পে বর্ণিত হয়নি।
৮. ধর্মঠাকুর :
কাব্যে ধর্মঠাকুরের মানবিক প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বর প্রদানে কিংবা বিপদ থেকে লাউসেনকে রক্ষা করবার সময় তার সক্রিয়তা লক্ষ্যণীয়।
৯. হরিহর বাইতি :
অন্ত্যজ চরিত্র, সে এক ক্ষুদ্র ঢোলক। তার মধ্যে মনুষ্য চরিত্রের অসাধারণ দিক ফুটে উঠেছে। টাকার বিনিময়ে প্রথমে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেও পরে বিবেকের দংশনে সে সব সত্যি জানিয়ে দিয়েছে।
————————————————————
সাহায্য – শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়