মেঘনাদবধ কাব্য

মেঘনাদবধ কাব্যে বিধি ও বিশ্ববিধান, লেখা মোবাশ্বের আলী

এক

স্বর্গ, মর্ত্য ও নরক, এই তিনের পটভূমিকায় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বিরচিত এবং এই বিপুল বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে কাব্যের নায়ক রাবণ অবস্থিত। রাবণকে অবলম্বন করে এবং তারই মাধ্যমে এ কাব্যে বিশ্ববিধানের অমোঘ বিধিকে উদ্‌ঘাটিত করা হয়েছে।

প্রচলিত ধর্মবোধ ও নীতিবোধের দিক থেকে আলোচনা করলে দেখা যায়, রাবণ সীতা অপহরণের ফলে পাপ করেছে। এজন্য চিত্রাঙ্গদা তাকে সাক্ষাৎভাবে অভিযুক্ত করেছে :

হায়, নাথ, নিজ কর্মফলে-

মজালে রাক্ষসকুলে, মজিলে আপনি।

মহাদেব তার প্রতি রুষ্ট :

অধর্ম-আচারী এই রক্ষঃ কুলপতিঃ 

তার পাপে হতবল হবে রণভূমে 

মেঘনাদ; মরে পুত্র জনকের পাপে।

দেব-দেবীরা তার প্রতি উদ্ধত এবং রাম-লক্ষ্মণ বানর-সেনার সহায়তায় তার সর্বনাশ করতে প্রবৃত্ত। সীতা অপহরণ লৌকিক নীতি এবং গার্হস্থ্য-ধর্মের দিক দিয়ে অত্যন্ত গর্হিত বলেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ম প্রপঞ্চ বিচলিত হতে দেখা যায়। রাবণকে পাপের শাস্তি দিতেই হবে। এজন্য বিশ্ব-বিধানের ধারক ও বাহক দৈবীশক্তির কী প্রচেষ্টা এবং স্বর্গ হতে মর্তব্যাপী রাবণ ধ্বংসের কী বিপুল আয়োজন!

রাবণের পাপের ভারে লঙ্কাপুরী ধ্বংসোন্মুখ। এই মহা সর্বনাশের মধ্যেও সে আনুগত্য স্বীকার করতে সম্মত নয়, বরং উদ্ধত ও অবিনীত। তার একান্ত বিশ্বাস, মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হ’লেই শত্রুপক্ষ অনায়াসে দমিত হবে। এই বিশ্বাস লঙ্কাপুরীর রাজলক্ষ্মীরও। মেঘনাদ যুদ্ধ করলে দেব-দেবীর সমূহ অনিষ্ট হবে, এ-আশঙ্কা করে রাজলক্ষ্মী বিচলিত হ’লেন এবং মেঘনাদকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বৈকুণ্ঠে গিয়ে ইন্দ্রকে কোন একটি উপায় উদ্ভাবন করতে বললেন।

মেঘনাদের অপর নাম ইন্দ্রজিৎ। মেঘনাদ হতে ইন্দ্রের পুনরায় ক্ষতি ও বিনষ্টের আশঙ্কা। তাই শচীসহ ইন্দ্র কৈলাসে দুর্গার কাছে গেল এবং তারা দু’জনেই আগামী যুদ্ধে রাবণ ও মেঘনাদবধের ব্যবস্থার জন্যে তাকে অনুরোধ করল। এদের সাথে কথোপকথনকালে দুর্গা পরম ভক্ত রামের পূজায় তুষ্ট হ’ল। তারপর রতির সাহায্যে মোহিনী মূর্তি ধারণ করে মদনকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গা যোগাসনশৃঙ্গে তপস্যারত মহাদেবের কাছে গেল। কামদেব মদনের শরে মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ হ’ল এবং দুর্গার মোহিনী মূর্তি দেখে সে মুগ্ধ ও আবিষ্ট হ’ল। তাই রূপমুগ্ধ মহাদেব অতি সহজেই দুর্গাকে মেঘনাদ হত্যার প্রক্রিয়া বলে দিল। লক্ষ্মণ দৈব-অস্ত্রে বলীয়ান হ’ল এবং মায়াদেবী তাকে চণ্ডীর দেউলে দেখা দিয়ে মেঘনাদ হত্যার উপায় জানাল। মায়া- দেবী তাকে বলল : 

যা চলি নগর মাঝে, যথায় রাবণি

নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে, পূজে বৈশ্বানরে।

সহসা, শার্দুলাক্রমে আক্রমি রাক্ষসে,

নাশ তারে! মোর বরে পশিবি দু'জনে

অদৃশ্য; নিকষে যথা অসি, আবরিব

মায়াজালে আমি দোঁহে।

এভাবে দৈবীশক্তির আনুকূল্যে লক্ষ্মণের পক্ষে মেঘনাদকে হত্যা করা খুব সহজ হ’ল। ইন্দ্র আশ্বস্ত ও দেব-দেবীর। তৃপ্ত হ’ল এবং বিশ্ববিধানের অমোঘ নিয়ম-নীতি অক্ষুণ্ণ রইল।

সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিধির দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিতঃ ‘শুভাশুভ ঘটে ভবে বিধির বিধানে।’ স্বর্গলোকে দেব-দেবী এবং মর্তলোকে মানব-মানবী এই বিধির শাসনাধীন। দৈবীশক্তি এই বিধির আজ্ঞাবহ এবং এর অমোঘ নিয়ম-নীতি নিষ্ঠুর ভাগ্যের মতই প্রত্যক্ষবৎ। এর গতি বা শক্তিকে রোধ করার সাধ্য কারো নেই। স্বয়ং মহাদেবও একে অপ্রতিরোধনীয় ও অলঙ্ঘনীয় বলে জানে :

হায়, দেবী, দেবে কি মানবে-

কোথা হেন সাধ্য রোধে প্রাক্তনের গতি?

এজন্যই দেখা যায়, রাবণ শক্তির আস্ফালনে যতই অস্থির হোক না কেন, তার যতই আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় থাকুক না কেন, এক দুর্জ্ঞেয় শক্তির লীলায় তাকে অভিভূত হতে হয়েছে। তাই কাব্যের প্রথমেই সে ইন্দ্রজিতের নিকট সংশয়কাতর হয়ে বলে ওঠে :

হায়, বিধি বাম মম প্রতি,-

কে কবে শুনেছে পুত্র, ভাসে শিলা জলে, 

কে কবে শুনেছে লোক মরি পুনঃ বাঁচে?

ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর পর তার সেই সংশয় ঘনীভূত হয়েছে :

জিজ্ঞাসহ ভূমণ্ডলে, কোন বংশখ্যাতি

রক্ষোবংশ-খ্যাতি সম? কিন্তু দেব নরে

পরাভবি, কীর্তিবৃক্ষ রোপিণু জগতে

বৃথা! নিদারুণ বিধি, এতদিনে এবে 

বাম মম প্রতি; তেই শুকাইল

জলপূর্ণ আলবাল অকাল নিদাঘে।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে সুদৃঢ় নিয়মভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত অথবা নিয়ম-নীতির দ্বারা শৃঙ্খলিত, তাকে বিশ্ববিধান বলা যেতে পারে। বিশ্ববিধান রক্ষার দায় ও দায়িত্ব বিধির। এই বিধিকেই এ-কাব্যে প্রাক্তন, ভাগ্য, অদৃষ্ট, নিয়তি ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে।

দুই

‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র বিধি বা ভাগ্যের সাথে গ্রীক ট্র্যাজেডির ফেট (moros)-এর তুলনামূলক আলোচনা অসংগত নয়। কেননা এ দু’য়ের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু তা নয়, মধুসূদনের কবি-কল্পনা গ্রীক ট্র্যাজেডির নিয়তিবাদ দ্বারা প্রবলভাবে আচ্ছন্ন হয়েছে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।

‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ বিধি যেমন সর্বশক্তিমান, গ্রীক ট্র্যাজেডিতে নিয়তিও তাই। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ দেখা যায় যে, মহাদেব বিধির শাসনাধীন; তেমনি গ্রীক ট্র্যাজেডিতে দেবরাজ জিউসও নিয়তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

গ্রীক ট্র্যাজেডিতে নিয়তি সম্পর্কে লোক-প্রচলিত সাধারণ ধারণা এই যে, এক অন্ধ দুর্জ্ঞেয় শক্তির দ্বারা মানবজীবন ও মানব-ভাগ্য তাড়িত এবং এই শক্তি নিয়ম-নীতি রহিত। এর খেয়াল-খুশি মানব জীবনে সকল দুঃখের নিদান। গ্রীক নিয়তি সম্পর্কে এই লৌকিক ধারণা নিতান্ত শিশু-সুলভ এবং সর্বাংশে ভ্রমাত্মক।

কেননা গ্রীক মনীষা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটি সুদৃঢ় সংহত ঐক্য ও নিয়মের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। আদি কবি হোমারের কবি-কল্পনায় তা প্রথম দিব্যরূপে প্রতিভাত হয়েছে। ট্রয়বাসী রাজকুমার প্যারিস কর্তৃক পরস্ত্রী হেলেনকে অপহরণের শাস্তি অনিবার্য। তাই দশ বৎসর ব্যাপী রক্তঘাতী সংগ্রামে ট্রয় ধ্বংস হয়ে গেল। পাপের পরিণাম এমনি ভয়াবহ বটে!

আরো পড়ুন :  বারোয়ারি উপন্যাস এবং শরৎচন্দ্র

পাপ বা অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করতে হবে, কোনমতেই এর ব্যত্যয় ঘটতে পারে না, — এ-কথা গ্রীক ট্র্যাজেডি-রচয়িতাগণ নিঃসংশয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রথমত, ঈস্কিলাসের ত্রয়ী নাটক ‘অরেস্টিয়া’ উল্লেখযোগ্য। আরটিয়ুসের বংশ পাপে কলঙ্কিত। আগামেমনন ট্রয় যাবার পথ সুগম করার জন্যে কন্যা ইফিগিনিয়াকে মিথ্যা ছলনায় মাতৃক্রোড় থেকে ছিন্ন করে দেবতার কাছে বলি দিতে নিয়ে গেল। কন্যাকে হারানোর বেদনায় এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্তাপ্রায় হয়ে ক্লাইটেমেনেস্ট্রা স্বামীর অবর্তমানে ইজিসথাসের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’ল। দশ বৎসর পর ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে আগামেমনন দেশে ফিরে এলে ক্লাইটেমেনেষ্ট্রা ইজিসথাসের যোগসাজসে তাকে হত্যা করে প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করল। পিতার অপমৃত্যুতে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত অরেষ্টিস জন্মদাত্রী জননী ও তার প্রণয়ীকে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নিল। কিন্তু অরেস্টিসের বিবেক তাকে বৃশ্চিকের ন্যায় দংশন করতে লাগল। ফিউরিয়া তাকে তাড়িত করতে লাগল এবং সে উন্মাদ-প্রায় হ’ল। এই নিদারুণ দুঃখভোগের ফলেই সে মার্জনা লাভ করল এবং ফলে তার পরিত্রাণ হ’ল।

একটি অভিশপ্ত পরিবারের বিষাদ-করুণ কাহিনী ‘অরেষ্ট্রিয়াতে’ বর্ণিত হয়েছে। পাপের ভয়াবহ পরিণাম, যা অরেষ্টিসকে উত্তরাধিকারসূত্রে বহন ও নিদারুণ প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে, তা আগামেমনন ও ক্লাইটেমেনেস্ট্রার কর্মফল মাত্র। এই উত্তরাধিকারসূত্রে অজিত বংশগত পাপ ও দুঃখভোগের হেতু কি? ‘এ কথাই ঈস্কিলাসের কবি-মানসকে বিচলিত করেছে। তিনি উপলব্ধি করেছেন, পাপের সূত্র ধরে ভাগ্য মানব-জীবনে যে দুঃখ ঘটায় তা বিধাতার চরম ও পরম আশীর্বাদস্বরূপ। এ দুঃখভোগের ফলেই আমাদের অন্তর্দৃষ্টি বা জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়, আমরা অন্ধকার থেকে আলোক লাভ করি এবং এভাবেই আমাদের আত্মোপলব্ধি ঘটে।

In visions of the night, like dropping rain, 

Descend the many memories of pain

Before the spirit's sight : through tears and dole

Comes wisdom o'er the unwilling soul –

A boon, I wot, of all Divinity

That holds its sacred throne in strength, above 

the sky!

(Agamemnon: trans, by E. D. A. Morshend)

ঈস্কিলাসের যে বংশগত পাপের সমস্যা, তা পরবর্তী নাট্যকার সোফোক্লিসও অনুধাবন করেছেন। এসূত্রে সোফোক্লিসের বিশ্ববিশ্রুত নাটক ‘রাজা ইডিপাস‘ উল্লেখযোগ্য। থীবীসের রাজা ইডিপাস নিতান্ত ভ্রান্তি বা অজ্ঞানতাবশত জন্মদাতা পিতা লেউসকে হত্যা করে এবং গর্ভধারিণী জেকুস্তার পাণিগ্রহণ করে। ইডিপাসের ঔরসে এবং জেকুস্তার গর্ভে দু’টি পূত্র ও দুটি কন্যা জন্মলাভ করে। কিন্তু যে মুহূর্তে ইডিপাস এই ঘৃণ্যতম পাপ সম্বন্ধে নিঃসংশয় হয়েছে, সেই মুহূর্তে যে পাপের শাস্তিকে স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিয়েছে এবং নিজের চক্ষু নিজেই উৎপাটন করেছে। শুধু তা নয়, আয়কৃত অপরাধের শাস্তির দরুন যে স্বেচ্ছায় মাতৃভূমি থীবীস থেকে নির্বাসিত হয়েছে।

তার এই নির্বাসনের কাহিনী ‘Oedipus at Colonus’-এ বর্ণিত হয়েছে। বহু বছরের অক্লান্ত ও নিরলস কৃচ্ছ সাধন এবং তপশ্চর্যার ফলে তার পাপ স্খলিত হ’ল এবং সে পরিত্রাণ লাভ করল।

ইডিপাস সজ্ঞানে কোন পাপ করে নি। সুতরাং তার শাস্তি অহেতুক বলে মনে হতে পারে। অবশ্য তা আপাতভাবে; গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর তাৎপর্য পাওয়া যেতে পারে। ইডিপাস যে-ভাবেই হোক না কেন পাপ করেছে এবং পাপকে স্বীকার করে নিয়েছে। সে সজ্ঞানে পাপ করেনি বলে পাপ ও পাপের শাস্তিকে অস্বীকার করার প্রয়াস পায় নি, বরং পাপের ভয়াবহ শাস্তিকে সহ্য ও স্বীকার করে নিয়েছে। এই পাপের সূত্র ধরে ভাগ্য যে-ভাবে তার জীবনে কার্যকরী এবং সে যে কঠোর দুঃখ-ভোগের সম্মুখীন হয়েছে, এরই ফলে তার জ্ঞানলাভ, আত্মোপলব্ধি এবং পরিণামে উদ্ধারলাভ সম্ভব হয়েছে।

গ্রীক ট্র্যাজেডিতে ভাগ্যকর্তৃক নির্দেশিত পাপের দরুন দুঃখভোগ, ফলে অজ্ঞানতা হতে জ্ঞান লাভ বা আত্মোপলব্ধি এবং পরিণামে মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ করতে দেখা যায়। এভাবে গ্রীক মনীষায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটি সুদৃঢ়, সংহত নিয়ম-নীতি পরিকল্পিত হয়েছে। দেবাধিরাজ জিউস হতে মর্তলোকবাসী সকলেই এই নিয়ম-নীতির অধীন। বিশ্ববিধানের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম-নীতি ভাগ্যরূপে মানব জীবনে সক্রিয় হয়ে থাকে।

তিন

ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনে অদৃষ্ট কথাটি বহুল প্রচলিত। অদৃষ্ট বলতে প্রচলিত অর্থে সাধারণত একটি অন্ধ, নিয়মনীতিহীন, দুর্বার শক্তিকেই বুঝায়। কিন্তু অদৃষ্ট বা ভাগ্য, এরূপ নিছক অন্ধশক্তিরূপে ভারতীয় সাহিত্য বা দর্শনে পরিকল্পিত হয় নি। ভারতীয় মনীষা ও ভাবুকতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’। এ দু’টি মহাকাব্যে ভারতীয় ভাব-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার পরাকাষ্ঠা ঘটেছে। তাই এ দুটি মহাকাব্য আলোচনা করলে, ভারতীয় দৃষ্টিতে ভাগ্য সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যেতে পারে।

‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ এ দুটি মহৎ সৃষ্টি বলেই, এদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক ইত্যাদি নানা স্তরের ও পর্যায়ের আলোচনা সম্ভব। কিন্তু আমাদের আলোচনা মুখ্যত দর্শন-সংক্রান্ত।

‘রামায়ণ’ এবং ‘মহাভারতে’ সুর ও অসুর অথবা ইষ্ট ও অনিষ্টের দ্বন্দ্বই প্রকটিত হয়েছে। ‘রামায়ণে’ রাম-লক্ষ্মণ ইষ্ট এবং রাবণ অনিষ্টের প্রতীক। ‘মহাভারতে’ পঞ্চপাণ্ডব ইষ্ট এবং ধৃতরাষ্ট্রের দুর্যোধন প্রমুখ শত পুত্র অনিষ্টের প্রতীক।

আরো পড়ুন :  মনিয়া প্রসঙ্গ ও জীবনানন্দ, অপব্যাখ্যার নিরসন

‘রামায়ণে’ রাম ও লক্ষ্মণকে আজীবন অহেতুক নিগ্রহ বা যাতনা ভোগ করতে হয়েছে। পিতৃসত্য রক্ষার জন্যে রামের দ্বাদশ বৎসর বনবাস, তারপর সীতা অপহরণের ফলে রাক্ষস রাবণের সাথে রামের মহাসংগ্রাম, আবার সীতার বনবাস এবং পরিশেষে প্রজা-মনোরঞ্জনার্থে সীতার অগ্নি-পরীক্ষা-এই তো ‘রামায়ণে’র মূল আখ্যান। সারা জীবন রাম বিরুদ্ধ শক্তি ও প্রতিকূল ভাগ্যের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে, কিন্তু এত দুঃখ-ভোগ করেও সীতালাভের সৌভাগ্য তার হ’ল না। পরিশেষে সে সুখী হতে পারল না, বরং তার জীবন দারুণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হ’ল।

‘রামায়ণে’র মতোই ‘মহাভারতে’ জীবনের নিঃসীম বেদনা করুণ রাগিণীতে গীত হয়েছে। কুরুপক্ষের ছলনা, শঠতা, কপটতা ও চক্রান্তের ফলে ধর্মনিষ্ঠ ও সত্যসন্ধ পঞ্চপাণ্ডবের নির্যাতনের অবধি রইল না। নিতান্ত অবস্থাবৈগুণ্যে তাদের মহাসমরে ব্যাপৃত হতে হ’ল। কিন্তু তারা যে রাজ্যলাভের আকাঙক্ষায় আজীবন প্রাণপাত প্রচেষ্টা করল, এক অর্থে তা অহেতুক বলে মনে হয়। জীবনে এত ক্ষয়-ক্ষতি, এত দুঃখ-বেদনার পর রাজ্যলাভ ও রাজ্যভোগের কী অর্থ হতে পারে !

‘রামায়ণে’ রামের এবং ‘মহাভারতে’ পঞ্চপাণ্ডবের নিদারুণ দুঃখভোগ আপাতভাবে অহেতুক বলে মনে হয়; কিন্তু এর সদুত্তর পাওয়া যায় ‘গীতা’য়। ‘গীতায়’ শ্রীকৃষ্ণ নিষ্কাম কর্ম, এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিষ্কাম কর্ম বলতে বুঝা যায় অবশ্য কর্তব্য কর্ম করে যাবে, কিন্তু ফলপ্রাপ্তির আশা কখনও করবে না। শ্রীকৃষ্ণের মতে ফলহীন কর্মই একমাত্র ঈপ্সিত হওয়া বিধেয়। অর্জুন ক্ষত্রিয় বলেই যুদ্ধ তার পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। এজন্যেই জ্ঞাতিযুদ্ধ ভয়ংকর হ’লেও শ্রীকৃষ্ণ তাকে এতে প্ররোচিত করেছেন, অথচ কোন ফললাভের আশা করতে দেননি। 

“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

না কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।

যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।

সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।

– কর্মে তোমার অধিকার, কিন্তু ফলে কদাচ (অধিকার) না হউক। তুমি কর্মফলহেতু হইও না; অকর্মে তোমার আসক্তি না হউক। হে ধনঞ্জয়। যোগস্থ হইয়া ‘সঙ্গ’ ত্যাগ করিয়া কর্ম কর। সিদ্ধি ও অসিদ্ধিকে তুল্য জ্ঞান করিয়া (কর্ম কর)। (এইরূপ) সমত্বকে যোগ বলে”।1

ভারতীয় হিন্দু দর্শনে অদৃষ্টবাদ কর্মবাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। ‘রামায়ণে’ রাম কর্তব্য-কর্মে লিপ্ত; এজন্যই তাকে দুঃখভোগ করতে হয়েছে এবং এই দুঃখভোগের দরুন সে দেবতার মহিমা লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। ‘মহাভারতে’ পঞ্চপাণ্ডব কর্তব্য পালনে যে অনলস সাধনা করেছে, এরই জন্য তাদের মোক্ষলাভ ঘটেছে। ভারতীয় হিন্দু দর্শনে কর্মফলের দরুন যে দুঃখভোগ, এর ফলশ্রুতি ঐহিক নয়, আধ্যাত্মিক। দুঃখভোগের যে ফললাভ তা পার্থিব জীবনের দেহ-সম্ভোগে নয়, অধ্যাত্ম জীবনে আত্মার মোক্ষলাভে। এই মতবাদকে শ্রীকৃষ্ণ ‘গীতা’র একটি সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছেন।

ভারতীয় অদৃষ্টবাদ সুগভীর অধ্যাত্মবোধপ্রসূত। এই অদৃষ্টবাদ মানবজীবনে কর্মকে প্রধান্য দিয়ে মোক্ষলাভের উপায় খুঁজেছে। কিন্তু গ্রীক বা হেলেনিক ভাবনা জীবন রসে-রঞ্জিত। জীবন-রসকে ভিত্তি করেই গ্রীক নিয়তিবাদ পরিকল্পিত হয়েছে। সেখানে মানুষের দুঃখবোধ কোন পার-লৌকিক সদগতির জন্য নয়, আত্মিক উন্নতিবিধানের জন্যই। তাই সেখানে মোক্ষলাভ অপেক্ষা মুক্তিলাভই প্রধান হয়ে উঠেছে এবং জীবনের অপার মহিমা কীর্তিত হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় ভাব-ভাবনা এই জীবনকে পরিক্রমণ ও অতিক্রম করে সর্বশেষে অন্য এক লোকে – অধ্যাত্মলোকে – উত্তরণ করে এবং এই অধ্যায় জগৎই হ’ল চূড়ান্ত লক্ষ্য।2

মধুসূদনের চরিত্রের মধ্যে একরূপ আদিম ও সহজ জীবন-রস-রসিকতা দেখা যায়। তাঁর স্বভাব বা প্রকৃতি সর্বতোভাবে ভারতীয় অধ্যাত্ম সাধনার পরিপন্থী। স্বভাবত তিনি গ্রীক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট এবং ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ ভাগ্য-পরিকল্পনায় গ্রীক ট্র্যাজেডির নিয়তিবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ ভাগ্য বা নিয়তি গ্রীক ট্র্যাজেডির অনুরূপ। 

‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র আদি হ’তে অন্ত পর্যন্ত বিধির করাল হস্ত প্রসারিত।

বিধি প্রসারিছে বাহু 

বিনাশিতে লঙ্কা মম, কহিনু তোমারে।

স্বকৃত অপরাধের শাস্তি রাবণকে ভোগ করতেই হবে। তাই দেখা যায়, তার বাহুবল, অস্ত্রবল ও মনোবল যতই থাকুক না কেন, তার পরাজয় অনিবার্য, অপ্রতিরোধনীয় ও অবশ্যম্ভাবী। সেই মহা সর্বনাশের চিত্রই এ কাব্যে আদ্যন্ত চিত্রিত হয়েছে। কাব্যের প্রথমেই তার পরাজয়ের সূচনা, ক্রমাগত তা প্রকটিত হয়েছে এবং পরিশেষে সে সর্বনাশের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। কাব্যের আদিতে বীরবাহুর মৃত্যু, মধ্যে ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদের বধ এবং অন্তে মেঘনাদ ও প্রমীলার শ্মশানযাত্রা। সমুদ্রতীরে শ্মশানে রাবণ প্রিয়তম পুত্র ও পুত্রবধূকে ভস্মীভূত করে জীবনে মহাশূন্যতাকে প্রত্যক্ষ করল।

এ কাব্যে রাবণের প্রতিপক্ষ শুধু রাম-লক্ষণ নয়, দৈবীশক্তিও। এই দৈবীশক্তি বিশ্ববিধানের ধারক ও বাহক। সীতা অপহরণের ফলে বিশ্বের নৈতিক নিয়ম ব্যাহত হয়েছে। তাই বিশ্ববিধানের নৈতিক নিয়ম রাবণের প্রতি খড়গহস্ত হতে দেখা যায় এবং তাকে ধ্বংসের বিপুল আয়োজনে মত্ত হয়। তাই রাবণের প্রতিপক্ষ রাম-লক্ষ্মণ এবং দৈবীশক্তির মত বিধিও – যে বিধি বিশ্ববিধানের রক্ষাকর্তা। এই বিধির অঙ্গুলিসংকেতে অথবা চক্রজালে মর্তলোকে রাম-লক্ষ্মণ, বিভীষণ ও রাজলক্ষ্মী এবং স্বর্গলোকে ইন্দ্র ও ইন্দ্রাণী, মদন ও রতি, মহাদেব ও পার্বতী প্রভৃতি তৎপর হয়ে ওঠে। বিধি কর্তৃক বিস্তারিত স্বর্গ-মর্তব্যাপী রাবণ ধ্বংসের যে বিরাট চক্রজাল, এর আভাস পাওয়া যায় সীতার প্রতি বসুন্ধরার উক্তিতে :

বিধির ইচ্ছায় বাছা, হরিছে গো তোরে 

রক্ষোরাজ; তোর হেতু সবংশে মজিবে 

অধম ! এ ভার আমি সহিতে না পারি, 

ধরিনু গো গর্ভে তোরে লঙ্কা বিনাশিতে।

তাই বিধির অলঙ্খনীয় বিধানে রাবণের পরাভব ঘটল।

আরো পড়ুন :  দ্বিতীয় ফ্রেডারিক আসলে কে? পড়তে জানে এমন এক মজুরের প্রশ্ন

অথচ রাবণ সুস্থ, সবল ও সরল মানবাত্মা। তার পাপ-পুণ্য বা ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই। এজন্যই বিধির রহস্যলীলা তার পক্ষে দূরায়ত্ত এবং বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদে তার মনে প্রশ্ন জাগে :

কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?

কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি, 

হরিলি এ ধন তুই?

দেহাত্মবাদী রাবণ আত্মশক্তিতে উদ্ধত ও অবিনীত। এই আত্মশক্তিতে স্ফীত হয়ে সে আপন সীমা উল্লঙ্খন করে বিশ্ববিধানকে আঘাত হেনেছে – অর্থাৎ পরস্ত্রী অপহরণের দুঃসাহস করেছে। একেই গ্রীক ট্র্যাজেডিতে hybris বা ঔদ্ধত্য বলা হয়। ঈস্কিলাসের প্রমিথিয়ুস hybris বা স্পর্ধায় বশবর্তী হয়েই আপন নিদ্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে দেবরাজ জিউসকে অবজ্ঞা করেছে। তাই তাকে নিদারুণ শাস্তি ভোগ করতে হয়।

সংসার সমাজ ও ধর্মের প্রতি মানুষের গণ্ডী সীমিত ও নির্দেশিত। এই নির্দিষ্ট গণ্ডী লঙ্ঘন করা হয় বলেই না যত বিপর্যয়।

কিন্তু বিশ্ববিধানের ধারক ও বাহক যে দৈবীশক্তি, সেই শক্তিকে মূর্ত করে তুলতে মধুসূদন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থকাম হয়েছেন। বিশ্ববিধান যদি ন্যায়নীতির নিয়ামক হয়ে থাকে তবে দেব-দেবীর চরিত্রেও তা প্রত্যাশিত – এবং এই তো স্বাভাবিক ও সঙ্গত। কিন্তু মধুসূদনের কল্পিত ও অঙ্কিত দেব-দেবী চরিত্রে আদৌ কোন ন্যায়-নীতি লক্ষ্য করা যায় না। স্বার্থপরতাই তাদের চরিত্রে চূড়ান্তভাবে প্রকটিত হয়েছে। রাবণ-পুত্র মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ বলে, দেব-দেবীদের যোগসাজসে ইন্দ্রের তাকে হত্যা করার কি না অমানুষিক প্রচেষ্টা ! রাম দুর্গাকে স্তব-স্তুতি করে বলেই দুর্গা রাবণ ধ্বংসের আয়োজনে লিপ্ত হ’ল। কামাতুর মহাদেব পার্বতীর রূপে মোহাবিষ্ট হয়েই মেঘনাদ-হত্যা ও রাবণ ধ্বংসের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে দিল – যদিও রাবণ মহাদেবের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। অথচ এই স্বার্থপরতাকে দেব-দেবীরা সার্বজনীন ন্যায়-নীতির নামে ঢাকা দিতে চেয়েছে এবং ধর্মের মুখোশ এঁটে পাপাচারী রাবণকে শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েছে। এতে তাদের চরিত্রগত কপটতা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বার্থপরতা ও কপটতা তাদের চরিত্রকে ম্লান করে দিয়েছে।

এ কাব্যে বিশ্ববিধান এবং দেব-দেবীর কার্যাবলী, এ দু’য়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিধান যদি কোন সার্বজনীন ন্যায়-নীতির রক্ষক হয়ে থাকে তবে তার ধারক ও বাহককেও অপক্ষপাত ও নিঃস্বার্থ হতে হবে – অন্ততঃপক্ষে নীতির দিক থেকে এই স্বীকার করা উচিত। কিন্তু দেব-দেবীরা নিঃস্বার্থ নয় বলেই বিশ্ববিধানের মধ্যে সার্বজনীন কল্যাণ ও মঙ্গলের রূপটি প্রকটিত হয় নি এবং দেবদেবীর মত একেও পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হয়। তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ভাগ্যের লীলা দেখা যায় এবং রাবণের জীবনে যা দুর্বার রূপে দেখা দিল, তাকে অত্যন্ত ক্রুর বলে মনে হয়। এ কাব্যে ভাগ্য অন্ধ, নির্মম ও নিয়মরহিত।

এজন্যই বলা যায়, রাবণের কার্যের সাথে তার ভাগ্যের সাক্ষাৎ কোন সম্পর্ক নেই। তার জীবনে ভাগ্য যেভাবে কার্যকরী হয়েছে এতে তাকে ভাগ্যের হাতে ক্রীড়নক বলে মনে হয়। তাই সে অহেতুক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে বার বার নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছে, এ কোন শক্তির লীলা তার জীবনে দেখা দিল ! এই অন্ধ শক্তিলীলায় মধুসূদন জীবনে ও কাব্যে অভিভূত হয়েছেন এবং এর স্বরূপ তিনি উদ্‌ঘাটন করতে চেয়েছেন। কিন্তু এ তাঁর কাছে রহস্যই রয়ে গেল। এর রহস্য রাবণের মতোই তাঁর পক্ষেও দুর্ভেদ্য। তাই ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ নিয়তিও রহস্যপূর্ণ। শুধু তা নয়, এ কাব্যে অঙ্কিত বিশ্বও রহস্যসংসক্ত হয়ে রইল।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ দার্শনিক ভিত্তিটি সুদৃঢ় নয়। মধুসূদনের বিশেষ কবিদৃষ্টিই এ কাব্যে চরম দুর্বলতার হেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বীয় মানসপুত্র রাবণের প্রতি পক্ষপাতবশত তিনি দৈবীশক্তিকে হেয় ও তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। এ নিতান্ত আক্ষেপের বিষয়, মহৎ কাব্য সৃষ্টি করতে হ’লে যে অপক্ষপাত ও মোহমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন তা তাঁর নেই। দেব-দেবীর চরিত্রগুলো নিঃস্বার্থ ও নিষ্কলুষ হ’লে এ কাব্যে বিধি ও বিশ্ববিধান সার্থকভাবে রূপায়িত হতে পারত।

মধুসূদনের ব্যর্থতার আরও এবটি হেতু উল্লেখ করা যেতে পারে। যে অধ্যাত্ম-গভীর অন্তর্দৃষ্টি থাকলে চির-অন্ধকারাবৃত বিশ্বের রহস্যোদ্ঘাটন করা সম্ভব তা তাঁর নেই। প্রতি মহৎ কবির মধ্যে – হোমার, ঈস্কিলাস, সোফোক্লিস, দান্তে – এই অধ্যাত্ম-গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। তাই তাঁদের কাব্যে একটি ঐক্যসূত্র এবং বিশ্বরহস্যের মর্ম উদ্‌ঘাটিত হতে দেখা যায়। মধুসূদন কেবল রহস্যসংসক্ত, কিন্তু রহস্যের অন্তরালে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে বিশ্বকে সমগ্র ও অখণ্ডভাবে আয়ত্ত করতে ব্যর্থকাম হয়েছেন। এখানেই বিশ্বের মহৎ কবিদের সাথে তাঁর যথার্থ ব্যবধান।


মধুসূদন ও নবজাগৃতি” (৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮৭) – মোবাশ্বের আলী, মুক্তধারা, ঢাকা, বাংলাদেশ। প্রবন্ধটি এই গ্রন্থ থেকে সংকলিত। 
মধুসূদন ও নবজাগৃতি
মধুসূদন ও নবজাগৃতি

  1. বঙ্কিমের শ্রীমদ্ভগবদগীতা হতে উদ্ধৃত। ↩︎
  2. এ সূত্রে উল্লেখযোগ্য যে, ভারতীয়দের মতো গ্রীক ভাবুকরা পরকাল এবং স্বর্গ নরক নিয়ে বড় একটা বিব্রত বোধ করতেন না। ↩︎

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *