বাংলা সাহিত্যে ইলিশ

বাংলা সাহিত্যে ইলিশ, দিগেন বর্মণ

প্রায় ১০৭ বছর আগে রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা “কষ্টিপাথর” নাটকে দেখা যায় নবীন একজোড়া ইলিশ কিনে সকলকে তা দেখিয়ে আহ্লাদিত হয়ে রাস্তা দিয়ে চলছে। এমন লোক খুঁজতে বর্তমানে অতদূর যাওয়ার দরকার নেই, বর্ষায় বাজারে গিয়ে আজও এক জোড়া ইলিশ মাছ কিনতে পারলে মধ্যবিত্ত বাঙালি মাত্রই আহ্লাদে আটখানা হয়ে ঐ নবীনবাবু হয়ে যান। তা হবেন নাই বা কেন। ইলিশ মাছ তাদের কাছে শুধু প্রিয়ই নয়, ইলিশ মাছ গর্বেরও।

১৯৭১ সালে ৬ জুন ইলিশ মাছ নিয়ে এক বেতার ভাষণে সাহিত্যিক সাংবাদিক পরিমল গোস্বামী অনামী এক কবির সংস্কৃত কবিতার বাংলা শুনিয়েছিলেন… বায়ু বিশ্বকে বহন করে আছে, তার উপর আছে কচ্ছপ, তার উপর আছে শেষ নাগ, তার উপর পৃথিবী, তার উপর কৈলাস শৃঙ্গ, তার উপর শিব, তার উপরে গঙ্গা এবং তার উপরে ‘ইলিশ’। ‘ইলিশ’ কে তিনি প্রায় ভগবান বানিয়ে ছেড়েছেন। আর একটি কথায় তিনি ইলিশকে গীতার একটি শ্লোকের সাথে তুলনা করেছেন। গীতায় ভগবান যেমন বলেছেন – যে আমাকে যেমনই ভজুক তাকে আমি তুষ্ট করি। ইলিশ হল মৎস্যরাজ। এর মাহাত্ম্য সর্বজনবিদিত। তাই আমাদের ইলিশ বলে যে যেমন করেই আমাকে ভজুক আমি তাকে তুষ্ট করি।” ইলিশের প্রলুব্ধকারী স্বাদ মানুষ যেমন ভুলতে পারে না, তেমনি যে একবার সেই আস্বাদ পেয়েছে তা থেকে তার নিষ্কৃতি নেই। ইলিশ ভক্ষণে সকল দুঃখ থেকে মুক্তি।

ইলিশকে এমন উচ্চাসনে কে বসাতে পারে ইলিশপ্রিয় না হলে এমন কেউ বলতে পারে? কথায় বলে রতনে রতন চেনে ইলিশপাগল চেনে ইলিশকে। ইলিশ-রসিক ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোচ সুভাষ ভৌমিকেরও মতে – দেখতে যেমন স্বাদেও তুলনা নেই, ইলিশ হল রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। কৌলিন্য আছে ভাই। গাড়ি চালিয়ে নামখানা পর্যন্ত যাই ইলিশ কিনতে। একে কী বলবেন?

চিত্তাকর্ষক লেখনীর শিল্পী বুদ্ধদেব গুহ একটা গল্প সংকলনের নামই রেখেছেন “ইলিশ”। বারোটি গল্পের সংকলনে প্রথম এবং প্রধান গল্পটির নামই “ইলিশ”। বরিশালের নৃপেনবাবু এখন কলকাতায়। স্মৃতির সোপানে চড়ে চলে গেছেন ইলিশের রাজ্যে। কল্পনার টাইম মেশিনে চেপে খেতে খেতে ইলিশের নানা পদ চেখেছেন। ইলিশ ভাজা, ইলিশ ডিম ভাজা, ইলিশের মাথা ভাজা এবং এসব ভাজার তেল দিয়ে ভাত মেখে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে খাওয়ার নস্টালজিক অনুভূতির কথা তিনি বলেছেন। তাঁর মতে “স্মৃতি বড় ভীষণ তেলতেলে, কিছুতেই ছাড়তে চায় না” – বলাই বাহুল্য সেটা ইলিশের।

ইলিশ বর্তমানে শুধু একটি খাদ্য হিসাবে আমাদের মধ্যে আর নেই, আমাদের সংস্কৃতির এক অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। ইলিশ মাছকে কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন ‘জলের উজ্জ্বল শস্য।’ মহম্মদ রফিকের আছে কবিতার বই, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গল্প। ব্যাণ্ড মিউজিকেও ইলিশ এসে গিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় হোটেল রেস্টুরেন্টে হচ্ছে ইলিশ উৎসব।

“পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ, লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মত দেখায়।

প্রেমেন্দ্র মিত্র’র ঘনাদায় পাই এক পা বাড়ালেই তো ডায়মন্ডহারবার। যাওয়া আসায় কোন হাঙ্গামাই নেই। ওখানকার… ইলিশ… একবার মুখে দিলে আর ডায়মন্ড হারবার ছাড়তে ইচ্ছে করবে না।

‘ফুটবল, মাছ, মারুতি’ প্রবন্ধে নবনীতা দেবসেন লিখেছেন, জোড়া ইলিশ মাছের জোড়া কবিতার বই দিলে বেশি খুশি হবো কি আমরা? বুকে হাত দিয়ে কজন বাঙালি কবিই বা একথা মেনে নেবেন নিজের কাছে।

রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রম্য নাটক কষ্টিপাথর (১৮৯৭) উন্নতিশীল বাবু নবীন একটাকায় এক জোড়া ইলিশ কিনে লোকদের বলছে “রাজপুত্তুর মশাই রাজপুত্তুর। কি যে গড়ন যেন ননীর চাপ থেকে কেটে তুলছে। দিব্বি দোহরা একটু পাশ থেকে গোলাপীর আভা মাচ্চে।”

ইলিশ মাছ নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে তর্ক, দলাদলি। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ ঈশ্বরী পাটনীর মনের কথা। বাঙালির জীবন থেকে দুধ উঠেছে আগেই, এসেছে মাছ। মাছখেকো বাঙালির তাই মনের কথা ‘আমার সন্তান যেন থাকে মাছে ভাতে”। এই কথাটি নাকি প্রতিটি বাঙালির মনের কথা। বাঙালির ইলিশপ্রীতি নিয়ে নতুন কিছু লেখা নিরর্থক। ৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে ১ বৈশাখে বিভিন্ন সংগঠন, উদীচী, শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমী, কবিতা পরিষদ ও বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী ১ বৈশাখ উদ্-যাপন উপলক্ষে এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে মাটির পাত্রে পান্তা ভাতের সাথে ভাজা ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রচলন করেছে। এমন কি এই দিনে অন্যান্য অনেক মেলা বসে, সেখানেও বিশেষ করে পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ খাওয়ার একটা পদ থাকেই। এর জন্য শুভেচ্ছা মূল্য খুব একটা বেশি দিতে হয় না। ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই হয়ে যায়, এ থেকেই বোঝা যায় বাংলায় ইলিশ শুধু সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; সে বাঙালি-সংস্কৃতির মধ্যেই ভাল ভাবে একটা স্থান করে নিতে পেরেছে।

মাছপ্রীতি সম্পর্কে কেউ যদি জানতে চায় তাহলে প্রশ্নকারীকে মাছের বাজারে না নিয়ে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলার দিন মাঠে নিয়ে গেলেই বোঝা যাবে এর সত্যতা। অনেক দিন আগে এক মাছশিকারির কাছে শুনেছিলাম একটি গল্প : একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে বললেন গোপাল তুমি যদি নদীর পাড় থেকে একটা ইলিশ মাছ কিনে রাজদরবার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে আসতে পারো, অথচ কেউ তোমাকে প্রশ্ন করতে পারবে না – এমন যদি হয় তাহলে তোমাকে আমি পুরস্কার দেবো। তবে সঙ্গে কিন্তু আমার লোক এর সত্যতা দেখতে যাবে।

মহারাজের কথায় গোপাল রাজি হয়ে যায়। যথা সময়ে ১টা বড় ইলিশ মাছ গঙ্গার পাড় থেকে কিনে হাঁটতে হাঁটতে রাজ দরবারে চলেছে, কেউ তাকে একটি প্রশ্নও করল না। রাজা গোপালকে জিজ্ঞাসা করলেন কী করে এ সম্ভব হল? গোপাল বলে মহারাজ মাছটি কিনে তার কানকোর পাশ দিয়ে একটি সুতো ঢুকিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছি। তারপর নিজের ধুতি তুলে মাথা ঢেকে রাজদরবারে এসে ধুতি নামিয়েছি। পথে শুধু কিছু লোক নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে দেখ পাগল আবার ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যায়। এই রকম আরো অনেক কাহিনি, প্রবাদ, শ্লোক, এমনকি ভোটের প্রচারে রেডিও বিজ্ঞাপনেও আছে ইলিশ মাছ। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনে একটি ভোটের ছড়া খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাহল –

ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বুয়াল মাছের দাড়ি

ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে

মুজিবের বাড়ি।' 

প্রবাদে আছে যে সব ক্ষেত্রে সম্ভব নয় এমন বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এটি–

'ইলিশ মাছ কি বিলে থাকে

কিলাইলে কি কাঁঠাল পাকে?'

আর একটি প্রবাদ – সেটি বিশেষভাবে উপযুক্ত বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ‘মারের সেরা পুলিশ আর মাছের সেরা ইলিশ’। বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশে রেডিওতে এখনও শোনা যায়, “মাছের রাজা ইলিশ/বাতির রাজা ফিলিপস।” দু’হাজার টাকার উপবে সোনাব জিনিস কিনলে একটি ইলিশ মাছ ফ্রি।

জনপ্রিয় থিয়েটারগুলোকে টেক্কা দিতে এবং তার থিয়েটার দেখতে দর্শকদের আকৃষ্ট করতে, এক থিয়েটার মালিক নাটক শেষে দর্শকদের উপহার দিতেন একটা গোটা ইলিশ। থিয়েটারের বিজ্ঞাপনটি ছিল অভিনয় দেখিতে আসিবার সময় গৃহিণীকে বিশেষ করিয়া বলিয়া আসিবেন যেন শেষ রাত্রে উনানে আগুন দিয়া তৈল প্রস্তুত রাখেন। অভিনয় দেখিবার পর, বাড়ি গিয়া গরম গরম ইলিশ মাছ ভাজা খাইয়া মন রসনায় তৃপ্তি সাধন করিবেন। ইলিশ এখন আর রান্নাঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন ইলিশ মান-সম্মান, ইজ্জৎ ও ঐতিহ্যের প্রতীক।

রামকৃষ্ণ একবার ভগবানের মাহাত্ম্য বোঝাতে ইলিশ মাছের কথা পাড়েন – “ভগবানের কি আশ্চর্য মহিমা ভাব : মাটির তিরিশ হাত উপরে সর্বক্ষণ রোদ খাচ্ছে কিন্তু খেলেই শরীর ঠাণ্ডা। কিন্তু ইলিশ গঙ্গার দশহাত গভীর অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় অথচ খেয়েছো কি পেট গরম।” এমন উদাহরণ আমার তো মনে হয় ইলিশ মাছের মতই হৃদয়গ্রাহী। এমনই আর একটি উদাহরণ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ – “ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায় প্রতিজ্ঞাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই সর্বনাশ।”

স্বামী বিবেকানন্দ একটি চিঠিতে ইলিশ মাছ সম্পর্কে লিখেছেন। ১৯০১-এর ৬ জুলাই বেলুড় মঠে বসে গঙ্গার দিকে চোখ রেখে তিনি এক চিঠিতে ক্রিস্টেনকে লেখেন… পৃথিবীতে এমন জিনিসটি হয় না। তার নদীতে ইলিশ উঠেছে। লিখছি আর দেখছি – ঘরের গায়ে ঢেউ ধাক্কা খেয়ে উছলে উঠছে। নিচে শত শত মাছ ধরার নৌকো সবাই ধরায় ব্যস্ত। আমাদের ইলিশ তোমাদের আমেরিকান ইলিশের চেয়ে বহুগুণে উৎকৃষ্ট। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই শুক্রবার বিবেকানন্দের শেষ মধ্যাহ্ন ভোজন সম্পর্কে স্বামী প্রেমানন্দের চিঠিতে জানা যায় “গঙ্গার একটা ইলিশ মাছ এ বৎসরে এই প্রথম কেনা হল। তার দাম নিয়ে আবার কত রহস্য হতে লাগল। একজন বাঙালছেলে ছিল তাকে বল্লেন “তোরা নূতন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কি দিয়ে পূজা করতে হয় কর”… আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন, কহিলেন – একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।”

রসরাজ অমৃতলাল বসু নাট্য রচনার আগে সঙ ও নক্সার জন্য নিয়মিত গান লিখতেন। ইলিশ নিয়ে এক রচনায় তারই অমৃত আস্বাদ :

'পাড়াতে কড়াতে কেহ মাছ ভাজে রাতে।

রন্ধনে আনন্দ বাড়ে গন্ধে মন মাতে ।।

লাউপাতা সাথে ভাতে সর্ষেবাটা মাখা।

সেই বোঝে মজা তার যার আছে চাখা।।

ভাতে মেখে খাও যদি ইলিশের তেল।

কাজে দেবে যেন কডলিভার অয়েল।। 

গরম গরম ভাজা খিচুড়ির সঙ্গে। 

বর্ষাকালে হর্ষে গালে তোলে লোকে বঙ্গে।। 

কাঁচা ইলিশের ঝোল কাঁচা লঙ্কা চিরে। 

ভুলিবে না খেয়েছে যে বসে পদ্মাতীরে।। 

ভাজিলে ঝালের ঝোলে ইলিশ অসার। 

কাঁচাতে অরুচি, রুচি মাখনের তার।। 

সর্ষে বাটা দিয়ে তাতে মাখাইয়া দধি। 

আমিরি আহার হবে রেঁধে খাও যদি।।"

‘সমাজ সংসার গ্রন্থে’ ‘কী পুজোয় খাব’ রচনায় – কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর রসনার কথা তার জবানীতে – সপ্তমী পূজোর দিন আমি সওয়া থেকে দেড় কেজি ওজনের এমন একটা সুলক্ষণ ইলিশ মাছ কিনব, যার পেটে সদ্য ডিমের ছড় পড়েছে। (সুলক্ষণ বলতে আমি সেই ধরণের ইলিশের কথা বোঝাচ্ছি, যার চেহারা একটু গোল গাল ধরনের, পিঠ চওড়া, পেট সরু এবং মাথাটা ছোটখাটো)। সেই সঙ্গে কিনব ঘন তামাটে রঙের কচুশাক। মাথাটা শাকের সঙ্গে যাবে। পেটি আর গাদার অর্ধেকটা দিয়ে দুপুরের জন্যে তৈরি হবে কালচে-সবুজ কাঁচা লঙ্কার লম্বা ঝোল, আর বাদ বাকিটা দিয়ে রাত্তিরের জন্যে তৈরী হবে ভাপের ইলিশ।

সৈয়দ মুজতবা আলির মত এমন ভোজনরসিক খুব কমই মেলে। তিনি লিখেছেন “আস্ত ইলিশ মাছ মাঝখান দিয়ে কেটে বাটা মশলা দিয়ে কলা পাতায় মুড়ে আগুনে সেঁকা হয়। এই মাছ দেবভোগ্য তো বটেই এবং এটা এতটাই স্বাস্থ্যকর যে এক আস্ত আড়াই তিন কিলোর ইলিশ গোটা খেলেও কোন রকম শরীর খারাপ হয় না।” তাঁর ইলিশপ্রীতির আরো একটা কাহিনি আছে। একবার পাঞ্জাবি এক মুসলমান অধ্যাপকের সাথে তার তর্ক বাঁধে। মুজতবা আলির মতে শ্রেষ্ঠ খাবার হল সরু চালের ভাত আর গঙ্গার ইলিশ। পাঞ্জাবি অধ্যাপকের মতে না ইলিশ মাছ নয় ‘বিরিয়ানি’; রাগ করে আলি সাহেব সেই অধ্যাপকের সাথে সাতদিন কথা বন্ধ করে দেন। একেই বলে ইলিশরসিক।

আরো একটি গল্প এখানে উল্লেখ করছি এই গল্পটি শুনি আমার বাবার কাছে – “ইলিশ আর হরিণ দুই বন্ধু, একবার তাদের মধ্যে তর্ক হয় কে বেশি দৌড়তে পারে। ইলিশ বলে আমি, হরিণ বলে আমি। তারপর শুরু হয় প্রতিযোগিতা। একজন জলে আর একজন ডাঙ্গায়। ফল ছিল সমান সমান। এজন্য ইলিশ মাছের খানিকটা অংশ পীত বা কালো ধরনের। এটা নাকি হরিণের মাংসর মত দেখতে আর হরিণের মাংস খানিকটা ইলিশ মাছের মত খেতে। বন্ধুত্বের নিদর্শন রাখতে ভগবান ইলিশের মধ্যে হরিণের মাংস আর হরিণের মধ্যে ইলিশ মাছের মত স্বাদ রেখেছেন, এই ধরনের গল্প আরো কয়েক জায়গায় প্রচলিত আছে। কাহিনি একই শুধু সেখানে হরিণ পরাজিত হয়। চুক্তি মত হরিণ ইলিশের সাথে মিশে যায়।

কলকাতার এক সাংবাদিক প্রতিবছর একটি করে ইলিশমাছ মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠান আর সাথে নিয়ে যান ইলিশ নিয়ে লেখা একটি কবিতা বা ছড়া। এই ছড়াগুলো মুখ্যমন্ত্রীর চাইতেও মুখ্যমন্ত্রীর মেয়ের বেশি পছন্দ, এমনকি ইলিশ মাছের চাইতেও। তাঁর দু’একটি ছড়া লিখছি:-

ক) 

“বর্ষে বর্ষে দলে দলে 

ওরা সেবা করে চলে 

জানা নেই নাম 

ইলিশ প্রণাম।"

খ)

"দিবারাত্র ব্যথা গাত্র 

দপ্তর যে পুলিশ 

এই ব্যথাকে মারতে পারে 

একটি মাত্র মালিশ 

আদি অকৃত্রিম 

পদ্মা নদীর ইলিশ।"

গ)

"বর্ষে বর্ষে দলে 

ওরা সেবা করে চলে 

কারও তীর্থ মক্কাধাম 

কারো কোলাঘাট।"

(আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩.৭.০৪)

কিছুদিন আগে ত্রিপুরায় সরকারি হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে সারি সারি ইলিশ মাছ শুয়ে থাকার সংবাদ খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। এই খবরটি ‘বেরোনর পর বাজারে ইলিশের দাম পড়ে গিয়েছিল, কারণ লাশকাটা ঘরে লাশের সাথে ইলিশের সহাবস্থানের ছবিটি নাকি ইলিশ কিনতে গেলেই ভেসে উঠছিল। কিছুদিন পর মানুষ আবার আস্তে আস্তে ভুলে যায়। ৮ আগস্ট ০৪ ত্রিপুরার স্থানীয় দৈনিক ‘ডেইলি দেশের কথা’-তে এই বিষয়ের উপর একটি কবিতা বেরিয়েছিল : 

জাতির জনককে খেয়ে আমরা কবেই অনাথ 

রবীন্দ্রনাথকে চুরি করে আমরাই পদক। 

শ্রুতির গৌরীসেন কানের কাছে 

অহরহ চেঁচিয়ে যাচ্ছে  

লাগে টাকা লাগে টাকা?

লাশঘরে ইলিশ, মৃতরা সব জেগে উঠে দেখে, 

শাক দিয়ে এত মাছ ঢাকা।'

(মঞ্জরী চৌধুরি, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়।)

অধিকাংশ সময় মাছ নিয়ে যে গল্প শুনে থাকি, তা হয় মজাদার। পাগলা সম্রাট মহম্মদ বিন তুঘলকের কথা একটু জানাই। আমরা সবাই জানি মহম্মদ বিন তুঘলক অবাস্তব পরিকল্পনার জন্য পাগলা রাজা হিসেবে বিখ্যাত। যেটা ইতিহাস বইতে চট করে পাওয়া যায় না, তা হল তুঘলকের মৃত্যু হয়েছিল অতিরিক্ত ইলিশ মাছ (পাল্লা) খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ফলে। এই কাহিনি থেকে বোঝা যায় ইলিশ মাছ যে শুধু চিত্তহরণই করে তা নয়, প্রয়োজনে প্রাণহরণও করতে পারে!

বিখ্যাত ‘কালবিবেক’ গ্রন্থরচয়িতা জীমূতবাহন ১২শ শতকেই ইলিশ মাছ আর ইলিশ মাছের তেলের নানান গুণের কথা বলে গিয়েছেন। তাঁর প্রশস্তির মূলে ছিল রসনার তৃপ্তি। জীমূতবাহন পদ্মার ইলিশ মাছ খেয়ে, না, গঙ্গার ইলিশ মাছ খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছিলেন তা তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি। সুতরাং তা নিয়ে আমাদের অযথা মাথাব্যথা করার প্রয়োজন কী? এখনও ইলিশ আমাদের অতি আদরণীয় খাদ্য বস্তুই নয়, ছড়া, প্রবাদ কবিতা, মেলা, উৎসব, বিবাহ, লোকগান ও লোকাচারের একটা আলাদা স্থান আছে। এ শুধু খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের জন্যই নয়, ইলিশ মাছের প্রতি ভালবাসার জন্যও।

ইলিশের সুলুক-সন্ধানে ছড়িয়ে আছে হয়তো আরো বহু অজানা কাহিনি। কথায় আছে, পররুচি পরনা, কিন্তু আপ রুচি খানা। সেই আপন রুচিতেই বাঙালিরা নাট্যচর্চা, সংগীত চর্চায় যেমন বহুদিন আগে থেকে নিবেদিত, তেমনি তার খাওয়াতেও। সেখানে ইলিশের যে এক বিশেষ স্থান আছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই সাহিত্যে নাটকে সংগীতে লোকাচারে আজও রসেবশে বাঙালি ইলিশি ঐতিহ্যেরই সন্ধানী।


সংযোজন : ইলিশ নিয়ে “ইলশে গুঁড়ি” নামে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি সুন্দর কবিতাও রয়েছে,

ইলশে গুঁড়ি ! ইলশে গুঁড়ি

ইলিশ মাছের ডিম ।

ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি

দিনের বেলায় হিম।

কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,

পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে, 

মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে 

আলতা-পাটি শিম্ 

ইলশে গুঁড়ি হিমের কুঁড়ি,

রোদ্দুরে রিম্ ঝিম

হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়

ইলশে গুঁড়ির নাচ, –

ইলশে গুঁড়ির নাচন দেখে

নাচছে ইলিশ মাছ।

কেউ বা নাচে জলের তলায়, 

ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়, 

নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়, 

পুকুরে ছিপ গাছ। 

উলসে ওঠে মনটা, দেখে 

ইলশে গুঁড়ির নাচ।

বাংলা সাহিত্যে ইলিশ
বাংলা সাহিত্যে ইলিশ
[দিগেন বর্মনের “ইলিশ পুরাণ” বই থেকে নিবন্ধটি ('সাহিত্যে ইলিশ') সংকলিত। সংযোজন অংশটি ব্যতীত।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *