| | |

মনিয়া প্রসঙ্গ ও জীবনানন্দ : অপব্যাখ্যার নিরসন

“মনিয়া” ও জীবনানন্দ

অর্থ সর্বদা নির্দিষ্ট থাকে না, বিশেষত কবির হাতে শব্দ তার প্রচল অর্থ হারিয়ে প্রায়শই নতুন অর্থ ধারণ করে। আর কবিতা এমনই এলাকা যেখানে প্রবেশ সাধারণের দুরধিগম্য। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ, অনুষঙ্গের তাৎপর্য ধরতে গেলে বুদ্ধি নয় — বোধ, প্রজ্ঞা এবং আবেগ লাগে। নয়তো অপব্যাখ্যার অন্ধকার পরিসর তৈরি হয়।
এমন অপব্যাখ্যার অন্ধকার পরিসরে কবিতার শব্দ নিয়ে যে একপ্রস্ত নির্বোধ বিশ্লেষণ জায়গা পাবে তাতে আর আশ্চর্য কী ! এখানে একটি কবিতার কথা উল্লেখ করা হলো যার শরীরস্থ একটি শব্দের অপব্যাখ্যা দৃষ্টান্তস্বরূপ। প্রসঙ্গক্রমে কবিতাটির কবি অবিসংবাদী পুরুষ জীবনানন্দ।
কবিতাটি হলো— ‘আকাশে সাতটি তারা’, ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত।
‘আকাশে সাতটি তারা’ কবির অসামান্য সৃষ্টি। কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙক্তিতে আছে —
‘….কামরাঙা- লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে…..’
আকাশের সাতটি তারা - জীবনানন্দ দাশ
আকাশে সাতটি তারা কবিতার প্রথম অষ্টক  

এই সন্ধ্যাকালীন গ্রামীণ প্রকৃতি-মুগ্ধতায় গোল বাধিয়েছে নিরীহ একটি শব্দ ‘মনিয়া’। কোনো কোনো নির্বোধ তার্কিক শব্দটিকে ‘মুনিয়া পাখি’ ধরে নিয়ে অপব্যাখ্যায় প্রয়াসী হয়েছেন। আসলে ‘মনিয়া’ একটি আরবি শব্দ। এর আদি উৎস গ্রীক-ল্যাটিন। গ্রীকভাষায় ‘menos’ নামে একটি শব্দ আছে যার অর্থ ‘single boy’ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে ল্যাটিনে শব্দটি হয়েছে ‘monica’. সেখানে মনিকা লগ্ন হয়ে আছে শিশুকন্যার নামের সঙ্গে। এই মনিকা থেকে পর্তুগিজ ভাষায় এসেছে ‘menina’. অনেকের মতে এই ‘menina’-ই আরবিতে মুনিয়া রূপ ধারণ করেছে। সম্ভবত আরবি ভাষা বাহিত হয়েই ‘মনিয়া’ বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করেছে। মনে রাখতে হবে ওপার বাংলার চট্টগ্রাম, বরিশাল অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাড়ির আদরের মেয়েকে আজও মনিয়া বলেই ডাকে।

এই হলো সংক্ষেপে মনিয়া বৃত্তান্ত। জীবনানন্দ দাশও বক্ষ্যমাণ কবিতাতে কন্যা সন্তান শব্দের অনুষঙ্গে মনিয়া শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই শব্দ নির্বাচনের উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।
কামরাঙার মত লাল মেঘ গঙ্গাসাগরের বুকে ডুবে যাওয়ার উপমা হিসেবে মনিয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। এক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতি কবির আয়ুধ হয়েছে। কবির মনে পড়েছে গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের কথা। কবি এর মধ্যে দিয়ে নির্মাণ করলেন যে চিত্রকল্প —
ক] নীলমৃত্যু উজাগর
খ] মৃত্যুর কাছে মানবজীবন অবনত হলেও নিসর্গ-সৌন্দর্য অমলিন, মৃত্যুর সম্মার্জনী তাকে মুছে ফেলতে পারেনি, পারে না। তাই গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে মেঘ ডুবে গেলেও নিসর্গ বিবর্ণ হয় না, বরং নতুন সৌন্দর্যে স্বপ্নিল হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গক্রমে ১৬.০৯.১৯৩১ সালে লেখা জীবনানন্দের দিনলিপির কিয়দংশ তুলে ধরা হলো —

….. মনিয়া ; Blue eyes (of portugese origin?) পাদ্রী সৈদপুর….

ঐ দিনলিপির শেষে প্রদত্ত নামপঞ্জিতে মনিয়ার পরিচয় দিতে স্পষ্টই বলা হয়েছে—

স্বদেশীয় রমনীর গর্ভের নীলনয়না মেয়ে ; বাড়ির কোনো আশ্রিতা খুব বেশি নয় এমন বয়সের মেয়ে, যার জন্মগ্রহণে সৈদপুরের পাদ্রির অবদান ছিল।

এছাড়া প্রদীপ দাশশর্মা রচিত ‘নীল হাওয়ার সমুদ্রে‘ শীর্ষক জীবনানন্দের জীবনীভিত্তিক উপন্যাসের সমালোচনায় প্রফেসর সুমিতা চক্রবর্তী জানিয়েছেন—

প্রথম পৃষ্ঠাতেই এসে গেছে মনিয়া প্রসঙ্গ।….. এই মনিয়া এক পর্তুগিজ পাদ্রীর কন্যা — হিন্দু বাঙালিনির গর্ভে তার জন্ম, মনিয়ার গলায় ক্রস ঝোলে।

[উপন্যাসের নায়ক জীবনানন্দ, সুমিতা চক্রবর্তী, দিবারাত্রির কাব্য – সাহিত্য সংখ্যা জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৩]
অর্থাৎ কবিতায় ‘মনিয়া’ শিশুকন্যার অনুষঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে— এই ধারনাই দৃঢ় হয়। তাহলে এখনো কি আর আলোচ্য কবিতার আলোচনায় ‘মনিয়া’কে ‘মুনিয়া পাখি’ বলা শোভা পায় ? অপব্যাখ্যা আর কতদিন চলবে ?

সূত্র : সঞ্জীব দাস, পরিচয়, আগস্ট -অক্টোবর, ২০১৫

আরো পড়ুন :  রবীন্দ্রসঙ্গমে বন্ধুবর্গ : শিলাইদহ পর্ব [ Friends of Rabindranath at Shilaidah ]
সংশ্লিষ্ট লেখা :
ক) জীবনানন্দ দাশ শতবার্ষিকী সংখ্যা – বিভাব পত্রিকা
খ) দিবারাত্রির কাব্য, সাহিত্য সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৩
গ) জীবনানন্দের দিনলিপি,  সম্পাদনা ভূমেন্দ্র গুহ
ঘ) নীল হাওয়ার সমুদ্রে, প্রদীপ দাশশর্মা

One Comment

Comments are closed.