গোবিন্দদাস সমস্যা ও নিরসনের সূত্র
আধুনিক বৈষ্ণব সাহিত্যের গবেষণায় বিদ্যাপতিকে নিয়ে উনবিংশ শতকে ও চণ্ডীদাসকে নিয়ে বিংশ শতকে যত সমস্যা ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে অন্য কোন বৈষ্ণব পদকর্তাকে নিয়ে এত বিচার ও আলোচনা হয় নি। তবে একটি ভিত্তিহীন সমস্যা দেখা দিয়েছিল গোবিন্দদাস কবিরাজকে কেন্দ্র করে।
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ১৮৬৯ খ্রি. হরিমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘কবিচরিত’ গ্রন্থে গোবিন্দদাসের প্রথম নামোল্লেখ মাত্র আছে। এরপর ১৮৭১ খ্রি. ‘বঙ্গভাষার ইতিহাস’ গ্রন্থে মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় গোবিন্দদাসের বিস্তৃত পরিচয় দান প্রসঙ্গে বলেছে—
গোবিন্দদাস কবিরাজ বুধুরী গ্রামনিবাসী রামচন্দ্র কবিরাজের ভ্রাতা ও শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য ছিলেন।
১৮৭৮ খ্রি. রচিত রাজনারায়ণ বসুর ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’য়ও ১৮৮০ খ্রি.রমেরশচন্দ্রের ‘The Literature of Bengal’ গ্রন্থেও গোবিন্দদাসের উল্লেখ আছে। উনিশ-বিশ শতকের বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় গোবিন্দদাস সম্পর্কে গবেষণা হয়েছে—
ক. ১২৮১ সালের জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব পত্রিকায়
খ. ১২৮২ সালের বান্ধব পত্রিকায় গোবিন্দিদাসের জীবনী ও কালনির্ণয় সম্পর্কিত গবেষণা আছে।
গ. ১২৯৯ সালের নব্যভারত পত্রিকায় ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরীও অনুরূপ গবেষণা করেছেন।
ঘ. ১৩০০সালে নব্যভারত পত্রিকায় হারাধন দত্ত ‘বঙ্গের বৈষ্ণব কবি’ প্রবন্ধমালায়,
ঙ. ১৩১১ সালে প্রদীপ পত্রিকায় শৌরেন্দ্রমোহন গুপ্ত-এর ‘শ্রীখণ্ডের প্রাচীন কবি’ প্রবন্ধমালায় গোবিন্দদাসের পরিচয় নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করেন।
কিন্তু এই সমন্ত আলোচনায় গোবিন্দদাস সম্পর্কে কোন সমস্যা দেখা দেয় নি। কিন্তু ১৩১১ সালে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত গোবিন্দদাসের বাঙালি পরিচয় সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে বিদ্যাপতির মতো গোবিন্দদাসকে মৈথিলী প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। মিথিলার গোবিন্দদাস ঝা নামক মৈথিলী কবির কয়েকটি পদই তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ। ১৩১১ সালের ভারতী পত্রিকার পৌষসংখ্যায় দীনেশচন্দ্র সেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের এই অপপ্রচেষ্টার প্রতিবাদ করে গোবিন্দদাসকে বাঙালি কবি বলেই প্রতিপন্ন করেন।
কিন্তু কিছুকাল নিবৃত্ত থাকায় পর নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত আবার গোবিন্দদাসকে মিথিলার কবিরূপে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। এ সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি মোট পাঁচটি প্রবন্ধ লেখেন—
অ. ১৩৩১ সালের কার্তিক মাসের মাসিক বসুমতীতে
আ. ১৩৩৫ সালের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায়
ই. ১৯৩০ খ্রি. ‘Modern review’ তে একটি করে মোট তিনটি এবং
ঈ. ১৩৩৬ সালে প্রবাসী পত্রিকায় দুটি—এই মোট পাঁচটি প্রবন্ধ রচনা করে গোবিন্দদাস কবিরাজের বাঙালিত্ব সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করেন।
নগেনাথ গুপ্তের এই অপচেষ্টার প্রতিবাদে সতীশচন্দ্র রায় বীরভূম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে ( ১৩৩২) ‘মহাকবি গোবিন্দদাস কি মৈথিল ? নামক প্রবন্ধ পাঠ করেন, এবং ১৩৩৩ সালের ভারতী পত্রিকায় গোবিন্দদাস কবিরাজকে বাঙালি বৈষ্ণব কবিরূপে প্রতিপাদন প্রচেষ্টায় সতীশচন্দ্র রায়ের দীর্ঘ গবেষণা প্রবন্ধ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
[ads id=”ads2″]
এরপর ১৩৩৬ সালের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় সুকুমার সেন ‘গোবিন্দদাস কবিরাজ’ শীর্ষক সুদীর্ঘ প্রবন্ধে গোবিন্দদাসের বাঙালিত্ব সম্পর্কে নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের এই অমুলক সংশয় ভিত্তিহীন প্রমাণ করে প্রচুর তথ্য ও দৃঢ় যুক্তি সহকারে গোবিন্দদাস কবিরাজকে শ্রীখণ্ডের বাঙালি কবিরূপেই প্রতিষ্ঠিত করেন। এটা কেবল প্রতিবাদ প্রবন্ধ নয়, এই দীঘ গবেষণা প্রবন্ধ গোবিন্দদাসের বিস্তারিত জীবন ও কাব্য পরিচয় হিসেবেও বিশেষ মূল্যবান। গোবিন্দদাস সম্পর্কে সর্বাধুনিক পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হয়েছে বিমানবিহারী মজুমদারের রচিত ‘গোবিন্দদাসের পদাবলী ও তাহার যুগ‘ গ্রন্থের ভূমিকায়।