হাসন রাজার বহুমাত্রিক চরিত্র
গগন, লালন এবং হাসন রাজার নাম এবং রচনাকে ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতায় এবং রচনায়। ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের অভিভাষণে (১৯২৫)লোক-দার্শনিক হাসন রাজা এবং তাঁর গানকে ইংরেজি অনুবাদে পরিবেশন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩০-এ অক্সফোর্ডে প্রদত্ত হিবার্ট বক্তৃতামালায় (দ্য রিলিজিয়ন অফ ম্যান) রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজার দু’টি রচনাকে অনুবাদ করে ব্যবহার করেন। ইংরেজি এবং বঙ্গানুবাদে এ সমস্ত রচনা ‘মডার্ন রিভিউ’, ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’, ‘প্রবাসী’ এবং ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে দেশের বিদগ্ধজনের কাছে গৃহীত হয়। শ্রীহট্টের হাসন রাজা ১৯০৭-এ তাঁর ‘হাসন উদাস’ গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। শ্রীহট্টের কলেজের ছাত্র প্রভাতকুমার শর্মার নিবন্ধ এবং তাঁর হস্তলিখিত গানের মাধ্যমে হাসন রাজার সঙ্গে পরোক্ষ পরিচয় ঘটে রবীন্দ্রনাথের। তখন হাসন রাজা মৃত। কিন্তু সে সময়ে ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের অভিভাষণ রচিত হচ্ছিল। সেই ভাষণে হাসন রাজা স্থান পেয়ে যান। কুসংস্কারে, দারিদ্রে জীর্ণ, ধর্মদ্বন্দ্বে কলঙ্কিত ভারতীয় জনগণের অন্য এক সাংস্কৃতিক সমন্বয়ী ঐতিহ্যের বাহক কবীর-দাদুর সঙ্গে বাংলার বাউলেরা গুরুত্ব পেয়েছিলেন রবীন্দ্র মননে। দেশে এবং বিদেশে সেইসব ভারত-পথিকদের সাহিত্য এবং দর্শনের প্রচারের বাসনায় রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজাকেও গ্রহণ করলেন।
বিখ্যাত ভূস্বামী পরিবারে হাসন রাজা জন্মেছিলেন। তাঁর সৎ-বোন উর্দু-বাংলায় কবিতা লিখতেন। হাসনের সন্তান একলিমুর রাজা রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য এবং খ্যাতিমান সাহিত্যিক ছিলেন। হাসন নিজের গানের বই ছাপিয়ে, গায়ক-গায়িকাদের গান শিখিয়ে মেলায়, মহোৎসবে পরিবেশন করতেন। পদকর্তা, সাধক এবং বিশিষ্ট এক গায়ন-রীতির প্রবর্তক হিসাবে হাসন রাজা শ্রীহট্টে, ময়মনসিংহে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কলকাতায় নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ শ্রীহট্টের হাসন রাজাকে গানের মাধ্যমে খ্যাতি দেন। বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ গায়ক এবং পদকর্তা হিসাবে হাসন রাজা গবেষণা এবং বৈদ্যুতিন প্রচার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত এক নাম। সাম্প্রতিক কালে ঢাকার বাংলা একাডেমি ‘সপ্ত সাধক’-এর মধ্যে তাঁকে স্থান দিয়েছেন।
লোকচিকিৎসার সংগ্রাহক এবং প্রয়োগকর্তা হিসাবে হাসনের নাম উচ্চারিত হলেও বিষয়টিকে কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। পদ্যে রচিত ‘সোখিন বাহার’ গ্রন্থে হাসন কুড়া, হাতি, ঘোড়া এবং নারীর বাহ্যিক দেহ-বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে তাদের স্বরূপ-স্বভাবকে সন্ধান করেছেন। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে, বৈষ্ণব-দেহতত্ত্বে এ পর্যালোচনা দৃষ্ট হয়। রূপের মধ্য দিয়ে স্বরূপের সন্ধান তো হাসনের জীবন-চিন্তার অন্য নাম। উন্নাসিক ভদ্রলোকেরা এ গ্রন্থের আলোচনায় বিরত থেকেছেন। নবদ্বীপের শ্রীহট্ট পাড়ায় চৈতন্যের পিতা-মাতা, পরিজনেরা এসেছিলেন স্বদেশ ছেড়ে। শান্তিপুরের অদ্বৈত গোস্বামীর আদিবাস শ্রীহট্টে। বহু সাধকের জন্মভূমি এই শ্রীহট্ট। এখানে শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব-বৌদ্ধ তন্ত্রাচারের সঙ্গে মিশেছিল হঠযোগ এবং লোকায়ত সাধনা। এখানেই বেসরা সুফিরা সমন্বয়ের সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। বন্ধু রাধারমণের সঙ্গে হাসন রাজার তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যাবে যে, রাধারমণ বৈষ্ণব ভাব-প্লাবনে নিমজ্জিত। অন্য পক্ষে, বৈষ্ণব প্রভাবকে স্বীকার করেও, সুফি ঐতিহ্য দিয়ে হাসন রাজা তাঁর ভাব, ভাবনা এবং ভাষার স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করেছেন।
মানবদেহের গৌরবে, অনিত্যে নিত্যের অন্বেষণে, ইহদেহবাদে, ইন্দ্রিয় দিয়ে সৃষ্টির মর্মের আনন্দকে অনুভবের বাসনায় লোকায়ত সাধকদের মতো হাসন রাজাও নিমগ্ন। অপ্রত্যক্ষ স্বর্গে তাঁর আগ্রহ নেই। ধনসংগ্রহে, সম্পত্তির বিস্তারে হাসন রাজা হৃদয়হীন, দেহ কামনায় তিনি অলজ্জ, নারীর হারেমের বজরায় তিনি জলে ভেসে চলেন। এরই সমান্তরালে সাধক, কবি, গীতিকার, প্রেমলোলুপ হাসন রাজার নানা সত্তা। এই নানা হাসনের খণ্ডচিত্র ভেসে ওঠে তাঁর গানে, সাধনার ভগ্নাংশ, নিঃসঙ্গতার বেদনা গানে ছায়া ফেলে। হাসন রাজার জীবন ও গানের খণ্ডিত ব্যাখ্যায় কেউ তাঁকে আদর্শায়িত করেছেন, কেউ প্রমাণ করেছেন তাঁকে যথার্থ মুসলমান বলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পদের যে-ব্যাখ্যা করেছেন, হাসনের অভিপ্রায় তা থেকে ভিন্ন হতেও পারে। মনের মানুষ প্রসঙ্গে সাধকদের ব্যাখ্যা যে রবীন্দ্র-ব্যাখ্যার অনুরূপ নয়, তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানিয়েছেন।
হাসানের পদাবলি গীতিকবিতার মতো বিচ্ছিন্ন কবিতা হিসাবে বিচার্য নয়। প্রশ্নোত্তরী রীতি অথবা সাধনক্রমের অংশ হিসাবে এগুলিতে রচয়িতার নানা বিরুদ্ধচিন্তা প্রকাশিত হয়। নামাজের গুণগানের সঙ্গেই নামাজাদির অসারতার কথা আছে তাঁর গানে। সামসুজ্জামান খান হাসনের আপাত বিরুদ্ধতত্ত্ববাণীর মধ্যে ঐক্যকে চিহ্নিত করেছেন। এ সমস্ত রচনার শব্দাবলি শেষ বিচারে দেহস্থ বস্তু বা ক্রিয়াবাচক। দেহসাধনার সংকেতপূর্ণ এ গানগুলি। শ্রীরামকৃষ্ণ যথার্থই বলেছেন, সাধন না করলে শাস্ত্রের মানে বোঝা যায় না। বিবেকানন্দের ব্যাখ্যায় উপনিষদ কথিত ‘মনের মানুষ হলেন, স্থূল দেহাভ্যন্তরের সূক্ষ্ম দেহের মধ্যে অবস্থিত সূক্ষ্মতম বহুযুগস্থায়ী নিত্য জীব বা আত্মা।’ বস্তু, বৃক্ষ, প্রাণিজগতের মধ্য দিয়ে বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে সে পায় মানব রূপ।
গীতা, চণ্ডী, ভাগবত এবং চৈতন্যচরিতামৃত ‘আমি’ তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। সুফিরাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তুমি-আমি নিয়ে হয় প্রশ্নোত্তরী বাউল গান। আমি-র প্রবক্তা হাসন যখন রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে ওঠেন, তখনই হাসন এবং রাধারমণের যৌথ উচ্চারণ শুনি, ‘তুমি ছাড়া কেহ নাই’। লালনের নম্রকণ্ঠ যুক্ত হয় তাতে। সে-উচ্চারণ শোনা যায় শাক্ত গানে, ‘তুমি নাই যথায় এমন স্থান আর কৈ? একে উপনিষদের সঙ্গে মেলান রবীন্দ্রনাথ এবং ক্ষিতিমোহন সেন।
এই প্রসঙ্গে মনসুর হাল্লাজ এবং সুফি দার্শনিকেরা স্মরিত হয়েছেন। হাল্লাজ ভারতীয় বেসরা সাধকদের মান্যব্যক্তিত্ব। তাঁর ‘আনাল হক’ তত্ত্বের পটভূমিকা ভিন্ন। জৈবসত্তার কোলাহলকে নফি (বাদ) করে, অন্তঃস্থিত ‘নুর’ সত্তাকে উজ্জ্বল করলে, মানুষ স্রষ্টার স্বরূপের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। এবং বলে ‘অনাল হক’। এই দুই সত্তার দ্বন্দ্বে হাসন বিভক্ত।
প্রেম স্রষ্টার দিব্য স্বরূপ। ভারতপথিক সাধকেরা অনেকেই প্রেমপন্থী। হাসন রাজাও। কাম, আত্মসুখ বাসনা প্রেমানুভবের অন্তরায়। বহুগামী কৃষ্ণ প্রেম অনুভবে ব্যর্থ হয়ে নদিয়ায় চৈতন্য রূপে প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। প্রেম ছিল তাঁর ‘প্রয়োজন’। কামনায়, বস্তু উপচারে, ভোগে বিশ্বের মর্মজাত প্রেম থাকে না। ধর্মশাস্ত্রে প্রেমের সাধনা নেই। প্রেম মর্ত্যে দেয় অমৃতের আস্বাদ। পঞ্চম পুরুষার্থ এ প্রেমে আর্ত শ্রীচৈতন্য। হাসন রাজাও।
গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী। বস্তুনিষ্ঠায়, মননে, নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক বিচার বোধে দু’বঙ্গেই তিনি অদ্বিতীয়। ভূমিকায় তিনি সমন্বয়ভূমি শ্রীহট্ট এবং সেখানকার সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এডওয়ার্ড ইয়াজিজিয়ান (Edward Yazijian)-এর ইংরেজি নিবন্ধটি সংযত এবং সংহত। মূল্যবান এই প্রবন্ধটির বানান ভুলগুলি পীড়াদায়ক। গ্রন্থের কোথাও অমিয়শঙ্কর চৌধুরী, মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী প্রমুখের হাসন রাজার গান ও জীবন বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ রচনাগুলির তালিকা থাকলে ভাল হত।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা ছিল আমাদের প্রায় অপরিচিত। এই রচনাগুলির উপস্থিতি পাঠকের ভাল লাগবে। সম্পাদক তাঁর নিবন্ধে বাউল পদকর্তা হিসাবেই হাসনের ভূমিকা চিহ্নিত করেছেন। গানেই হাসনের আত্ম-বিবরণ, আত্মজীবন এবং আত্ম-উদঘাটন। হাসন রাজার উত্তর-পুরুষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং তাছাওয়ার রাজা, হাসনের কালিমামোচন করে ও আদর্শায়িত করে, তাঁকে স্থাপন করেছেন ইসলামি-বৃত্তে। শামসুজ্জামান খান এবং আশরাফ সিদ্দিকির রচনা দু’টি গভীরতর বিচার বিশ্লেষণে মূল্যবান। দেবদাস জোয়ারদার তুলনামূলক আলোচনা করে হাসন রাজার সাহিত্যকে বিচার করেছেন। যেমন তপন বাগচী লোকায়ত ঐতিহ্যের আলোকে হাসন রাজাকে বুঝতে এবং বোঝাতে চেয়েছেন। দোষগুণ-সহ নানা হাসন রাজার বহুমাত্রিক চরিত্র এবং রচনা এ নিবন্ধাবলিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। হাসন রাজার অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক চিন্তা চেতনাকে উত্তরকালের হাতে তুলে দেওয়ার সম্পাদকীয় অঙ্গীকার এ গ্রন্থে সার্থক হয়েছে।
———————————————–
গ্রন্থ- হাসন রাজা : মরমি মৃত্তিকার ফসল
সম্পাদনা : আবুল আহসান চৌধুরী
উৎস প্রকাশন, ঢাকা
———————————————-
বইয়ের দেশ