ছবি- উইকিপিডিয়া


রবীন্দ্র-জীবনে ও সাহিত্যে শাহজাদপুর একটি অবিস্মরণীয় নাম। সুদীর্ঘ জীবনকালে স্বদেশের এবং বিদেশের বহুস্থান ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই সকল ভ্রমণের কারণ এবং উপলক্ষ্য ছিল প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পৃথক। কিশোর বয়সে পিতার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণ থেকেই প্রধানত তাঁর ভ্রমণের শুরু। শাহজাদপুর ভ্রমণ নিতান্তই বৈষয়িক কারণে। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বিলাত থেকে ঘুরে আসার পর জমিদারি তদারকীর ভার ন্যস্ত হয় রবীন্দ্রনাথের উপর।

উত্তরবঙ্গে বিরাট জমিদারি ঠাকুরদের।তার মধ্যে বেশি আয়ের ছিল শাহজাদপুর। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও কালীগ্রামের জমিদারি ঠাকুরদের হাতে আসে। ১৮৪০ সালের ২০ আগস্ট মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পৈত্রিক ডিহি শাহজাদপুর ও পরগণা কালীগ্রাম একত্র করে এর ভার একটি ট্রাস্টি বোর্ডের উপর দেওয়া হয়।পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের হাতে আসার পর প্রতি বছরেই তিনি বোটে করে এই সমস্ত জমিদারি পরিদর্শন করে বেড়াতেন। তবে শাহজাদপুর ও শিলাইদহেই তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। সেই জন্যে এই দুই স্থানে তিনি বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করতেন।

রবীন্দ্রনাথ ও শাহজাদপুর সম্বন্ধে লিখতে গেলে শাহজাদপুরের অবস্থান সম্বন্ধে আর একটু আলোচনা প্রয়োজন। শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনী প্রথম খণ্ডে লিখেছেন

বিলাত হইতে আসিবার কয়েক মাসের মধ্যে কবিকে উত্তরবঙ্গে যাইতে হয়। তখন তিন পরগণা, বিরহামপুর ইহার কাছারী শিলাইদহ :কালীগ্রাম ইহার কাছারী পতিসর : শাহজাদপুর গ্রামের নামেই পরগণা


–কিন্তু শেষ কথাটি ঠিক বলতে পারি না। কারণ শাহজাদপুর গ্রাম ইসবশাহী যা ইউসুফশাহী পরগণার অন্তর্গত। আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রজা ছিলাম এবং আমাদের বসত বাটি ঠাকুর জমিদারদের দেওয়া ব্রহ্মত্র ভূমির উপর। জমির কাগজ পত্রে পরগণে ইসবসাহী, মৌজে দ্বারিয়াপুর বলে উল্লেখ আছে।

আর একটা কথা– শাহজাদপুর ও পতিসর উত্তরবঙ্গে হলেও, শিলাইদহ কিন্তু উত্তরবঙ্গে নয়। শিলাইদহ, বিরহামপুর পরগণা মধ্যবঙ্গে বা দক্ষিণবঙ্গেও অবস্থিত বলা যেতে পারে।

কবি বিলাত থেকে আসার কয়েক মাস পরে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে শাহজাদপুরে প্রথম আসেন। এই সঙ্গে একটা কথা এই যে, তিনি এর পর কতদিন পর্যন্ত শাহজাদপুরে যাতায়াত করেছিলেন?

আমার কাছে শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি রক্ষিত (শুনছি,বর্তমানে আর নেই) রবীন্দ্রনাথের এখানকার জমিদারি সংক্রান্ত একটি অর্ডার বুক বা হুকুমনামা বইয়ের কিছুটা নকল আছে, তাতে দেখছি–রবীন্দ্রনাথের শেষ হুকুমের তারিখ ১১ ফাল্গুন ১৩০৩ সাল অর্থাৎ ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি। এ থেকে বলা যেতে পারে ১৮৯০-এর জানুয়ারি থেকে অন্তত ১৮৯৭-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুরে এসেছেনই।

আমার বন্ধু বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক গোপালচন্দ্র রায় তাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী’ গ্রন্থে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, ওই ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের যৌথ জমিদারি ভাগ হয়ে শাহজাদপুর অংশ রবীন্দ্রনাথের মেজকাকা গিরীন্দ্রনাথের বংশধরদের হাতে গেলে তখন থেকে কবি শাহজাদপুরে আসা ছেড়ে দেন।
গোপালবাবু এও দেখিয়েছেন যে, শাহজাদপুর গিরীন্দ্রনাথের বংশধরদের হাতে চলে গেলে, এর কয়েক মাস পরে ১৩০৪ সালের ৮ আশ্বিন রবীন্দ্রনাথ পতিসর যাওয়ার পথে তাঁর প্রিয় এই শাহজাদপুরে আর একবার এসেছিলেন, এবং সেদিন তার শাহজাদপুরের বিচ্ছেদকে স্মরণ করে এখানে বসেই বৈষ্ণব কবিদের বিরহ-বিচ্ছেদের গানের অনুসরণে তাঁর বিখ্যাত সেই যাচনা কবিতাটি বা গানটি লিখেছিলেন। সেই গানের প্রথমটা এই

ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখিয়োতোমার
মনের মন্দিরে।

শাহজাদপুর থেকে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিতে শাহজাদপুরে রবীন্দ্র-স্মৃতির অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে রবীন্দ্রনাথের লেখা ওই চিঠিগুলির কয়েকটি থেকে কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি



[১]


ফেব্রুয়ারি, ১৮৯১
আমাদের এই কুঠিবাড়ির এক তলাতেই পোস্ট আপিসবেশ সুবিধা চিঠি আসবামাত্রই পাওয়া যায়। পোস্টমাস্টারের গল্প শুনতে আমার বেশ লাগে। বিস্তর অসম্ভব কথা বেশ গভীর ভাবে বলে যায়। কাল বলছিল, এ দেশের লোকের গঙ্গার উপর এমনি ভক্তি যে, এদের কোনো আত্মীয় মরে গেলে তার হাড় গুঁড়ো করে রেখে দেয়, কোনো কালে গঙ্গার জল খেয়েছে এমন লোকের যদি সাক্ষাৎ পায়, তা হলে তাকে পানের সঙ্গে সেই হাড় গুঁড়ো খাইয়ে দেয়, আর মনে করে আত্মীয়ের একটা অংশের গঙ্গা লাভ হল। আমি হাসতে হাসতে বললুম, এটা বোধ হয় গল্প ? সে খুব গম্ভীর ভাবে চিন্তা করে স্বীকার করলে,হুজুর, তা হতে পারে



[২]


সাজাদপুর২৯-৬-৯২
তোকে চিঠিতে লিখেছিলাম, কাল 7 PM. এর সময় কবি কালিদাসের সঙ্গে একটা এনগেজমেন্ট করা যাবে। বাতিটা জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে কেদারাটি টেনে যখন বেশ প্রস্তুত হয়ে বসেছি, হেনকালে কবি কালিদাসের পরিবর্তে এখানকার পোস্টমাস্টার এসে উপস্থিত। মৃত কবির চেয়ে একজন জীবিত পোস্টমাস্টারের দাবি ঢের বেশি। অতএব পোস্টমাস্টারকে চৌকিটি ছেড়ে দিয়ে কালিদাসকে আস্তে আস্তে বিদায় নিতে হল। এই লোকটির সঙ্গে আমার একটু বিশেষ যোগ আছে। যখন আমাদের এই কুঠিবাড়ির এক তলাতেই পোস্টঅফিস ছিল এবং আমি প্রতিদিন এঁকে দেখতে পেতুম, তখনি আমি একদিন দুপুর বেলায় এই দোতলায় বসে বসে পোস্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম। এবং সে গল্পটি যখন হিতবাদীতে বেরোল, তখন আমাদের পোস্টমাস্টারবাবু তার উল্লেখ করে বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্য বিস্তার করেছিলেন। যাই হোক, এই লোকটিকে আমার বেশ লাগে। নানারকম গল্প করে যায়, আমি চুপ করে শুনি।



[৩]


সাজাদপুর৫-৯-১৮৯৪
অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানালা দরজা, চার দিক থেকে অবারিত আলো এবং বাতাস আসতে থাকে যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডাল চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই দক্ষিণের বারান্দায় বেরোবা-মাত্র কামিনী ফুলের গন্ধে মস্তিষ্কের রন্ধ্রগুলি পূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ বুঝতে পারি এতদিন বৃহৎ আকাশের জন্যে ভিতরে ভিতরে একটা ক্ষুধা ছিল, সেটা এখানে এসে পেট ভরে পূর্ণ করে নেওয়া গেল। আমি চারটি বৃহৎ ঘরের একলা মালিক–সমস্ত দরজাগুলি খুলে বসে থাকি। এখানে যেমন আমার মনে লেখবার ভাব এবং লেখার ইচ্ছা আসে, এমন আর কোথাও না।



[৪]


সাজাদপুর২৮-৬-৯৫
বসে বসে সাধনার জন্যে একটা গল্প লিখছি একটু আষাঢ়ে গাছের গল্প। লেখাটা প্রথম আরম্ভ করতে যতটা প্রবল অনিচ্ছা ও বিরক্তি বোধ হচ্ছিল, এখন আর সেটা নেই। এখন তারই কল্পনাস্রোতের মাঝখানে গিয়ে পড়েছি– একটু করে লিখছি এবং বাইরের প্রকৃতির সমস্ত আলোক এবং বর্ণ এবং শব্দ আমার লেখার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।


এই চিঠির আষাঢ়ে গোছের গল্পটা হল রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গল্প—‘ক্ষুধিত পাযাণ

[৫]


সাজাদপুর২-৭-১৫
কাল থেকে সাজাদপুরের কুঠি বাড়িতে উঠে এসেছি।..বেশ লাগছে। মাথার উপরে ছাদের অনেক উঁচুতে এবং দুই পাশে দুই খোলা বারান্দা থাকাতে আকাশের অজস্র আলো আমার মাথার উপরে বর্ষণ হতে থাকেসেই আলোতে লিখতে পড়তে এবং বসে বসে ভাবতে ভারী মধুর লাগে।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পগুচ্ছ কয়েকটি গল্প ছাড়া, তাঁর সোনার তরী থেকে চৈতালী রচনা যুগের অনেকগুলি কবিতা এবং গানও এই সাহজাদপুরে রচনা করেছিলেন। এখানে বসে লিখেছিলেন– তাঁর বিসর্জন নাটকটি, আর কিছু প্রবন্ধও।


——————————

গ্রন্থ- শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ

আরো পড়ুন :  শরৎচন্দ্র ও নাটক প্রসঙ্গ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *