স্যার উইলিয়াম রোদেনস্টাইন (১৮৭২-১৯৪৫) প্রধানত পরিচিত ছিলেন একজন ইংরেজ চিত্রশিল্পী হিসেবে।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় কলকাতার ৫ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁদেরই বিখ্যাত দক্ষিণের বারান্দায় – যেখানে অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল ও দুর্লভ শিল্প সংগ্রহশালা। বিদেশ থেকে কোনো বিশিষ্ট সমঝদার এলে এখানে এসে সেই শিল্প সংগ্রহ দেখতেন।
ছবি : ইন্টারনেট |
এই শিল্পীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার কিছু অনুবাদ পাঠিয়ে দেন পড়ে দেখার জন্য। ইতিমধ্যে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের দেবেন্দ্রনাথ মিত্র-কৃত ইংরেজি অনুবাদ ‘মডার্ন রিভিউ’-তে প্রকাশিত হয় ১৯১১-এর জানুয়ারি মাসে। এটি রােটেনস্টাইনের চোখে পড়ে এবং লেখক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় শুরু হয়। এরপর ওই একই পত্রিকায় ভগিনী নিবেদিতা-কৃত ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের অনুবাদ পাঠ করে তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর আরও কবিতা পড়তে চেয়েছিলেন। ১৯১০-১১ তে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকখানি পােট্রেটও এঁকেছিলেন রােটেনস্টাইন। এই ছবি-আঁকার মধ্য দিয়েই উভয়েই পরিচিত ঘনিষ্ঠ হয়। পরে লন্ডনেও তিনি রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো ছবি আঁকেন।
আর্বানা
১৫ ডিসেম্বর ১৯১২
প্রিয় বন্ধু,
আপনার পাঠানো পান্ডুলিপিগুলি পেয়েছি। গতরাত্রে একদল বন্ধুভাবাপন্ন শ্রোতার সামনে ‘দ্য পোস্ট অফিস’ (‘ডাকঘর’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ) পড়ে শোনালাম, আন্তরিক সমাদর পেলে। কবি হিসেবে আমার খ্যাতি দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ছে এ দেশে, তবে এখানো এতটা হয়নি যে এখানে আমার থাকা অসম্ভব করে তুলবে। এখনও আমি নিজেকে নিয়ে আপনমনে থাকতে পারছি। সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত লোকেরা এসে আমার ছবি চেয়েছিল, আমার জীবনীর উপাদান চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাদের ঠেকিয়ে রেখেছি – তবে আমার বিশ্বাস, তারা রথীর কাছ থেকে পেয়ে গেছে তারা যা চায়। রথী লােকজন ভালোবাসে, তাদের নিরাশ করতে চায়নি। … আপনার দেশে আমার রচনা খুবই উদার প্রশংসা পেয়েছে। এরকম যে হতে পারে কখনো ভাবিনি। এত অপ্রত্যাশিত যে কখনো কখনো আমার নিজেকে খুব ভারাক্রান্ত বলে মনে হয়। রসিকজনের কাছে গৃহীত হওয়াই শিল্পীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, কিন্তু তার উপর যেন নির্ভরশীল হয়ে না পড়ি আমরা। বিদেশে এই খ্যাতির একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে– এ যেন ক্রমশ জড়িয়ে ধরছে আমাকে; অচেতনভাবে আমি আরও আরও বেশি প্রশংসার প্রত্যাশী হয়ে পড়ছি। …
(‘Imperfect Encounter’ থেকে অনূদিত)
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রোদেনস্টাইন যে টেলিগ্রাম ও চিঠি পাঠান তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ সেই কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছেন যেটি এই উপলক্ষে সংবর্ধনা উত্তরে পরে অনেকবার ব্যবহার করেছেন। ১৮ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখে শান্তিনিকেতন থেকে কবি লিখলেন :
… আমাকে যে নোবেল পুরস্কারের মতো একটি বিশাল সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে, এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই আমার আপনার কথা মনে পড়ল – ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা সহ। আমি নিশ্চিত যে আমার বন্ধুদের মধ্যে আপনিই এই সংবাদে সকলের চেয়ে বেশি আনন্দিত হবেন। তবে তা হলেও, এটা আমার পক্ষে শাস্তিস্বরূপই হয়ে দাঁড়াল। এর ফলে জনতার উত্তেজনা এমন ঘূর্ণবাত্যার মতো আবিল হয়ে উঠছে যে সেটা আমার পক্ষে অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কুকুরের লেজে একটা টিনের কৌটো বেঁধে দিলে সে যেমন শব্দ ছাড়া নড়তে পারে না – যেখানেই সে যায় শব্দটা তাকে তাড়া করে বেড়ায়, আর চারধারে দর্শকদের ভিড় জোটায়, আমার অবস্থাটা তার চেয়ে খুব একটা ভালাে নয়। গত ক’দিন ধরে চিঠি আর টেলিগ্রামের ভিড়ে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে বসেছি; যারা জীবনে আমার লেখা একটা লাইনও পড়েনি তারাই হৈ চৈ আরম্ভ করেছে সবচেয়ে বেশি।… আসলে তারা সম্মান জানাচ্ছে আমার সম্মানটাকে, আমাকে নয়। একমাত্র যা আমাকে তৃপ্তি দিচ্ছে তা হল, এই উপলক্ষে আমার স্কুলের ছেলেদের অবিমিশ্র আনন্দ। …
(‘Imperfect Encounter’ থেকে অনূদিত)
ছবি : ইন্টারনেট |
এখানে লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মতো সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়ার ঘটনাকে কীভাবে কৌতুক করেছেন ‘কুকুরের লেজে একটা টিনের কৌটো’ বেঁধে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করে যাতে সে তার চারধারে দর্শকদের ভিড় জোটায়।
5