“নিম সাহিত্য” পত্রিকা

কেন্দ্রিক সাহিত্য আন্দোলন

১৯৭০ সালে দুর্গাপুর শিল্পনগরীতে একদল কল-কারখানার কর্মী যুবক সুধাংশু সেন, রবীন্দ্র গুহ, বিমান চট্টোপাধ্যায় ও মৃণাল বণিক প্রমুখ এই আন্দোলনের সূচনা করেন।
বাংলা সাহিত্যের আন্দোলনগুলি শহরকেন্দ্রিক হলেও কলকাতা থেকে দূরে শিল্পাঞ্চলে এমন একটি আন্দোলন সংগঠিত হলাে ১৯৭০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ‘নিম সাহিত্য’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ৩এ/৪১ রামকৃষ্ণ এভিনিউ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল সুধাংশু সেন ও বিমান চট্টোপাধ্যায়ের। যদিও এই পত্রিকার মূল পরিকল্পনার নকশা রচনায়, প্রতিটি সংখ্যার Lay out, ক্যাপশন বিষয়গত নির্বাচন ইত্যাদি ব্যাপারে রবীন্দ্র গুহ’র ভূমিকা ছিল অনেকটা নাছােড়বাদা।
দুর্গাপুরের মতাে শিল্প প্রধান অঞ্চলে যেখানে বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন সক্রিয়, ট্রেড ইউনিয়ন অটুট, সেখানে নিম সাহিত্য সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে সাহিত্য
বিস্ফোরণ ঘটালো।

এদের পত্রিকার শিরােনামে লেখা থাকতো ‘না সাহিত্য অল্প সাহিত্য তিক্ত বিরক্ত সাহিত্য।’ সারা পত্রিকায় নানা জায়গায় ছড়ানাে স্লোগান —

১. সাহিত্য অভিজ্ঞতার ফল নয়, অবিকৃত অভিজ্ঞতাই সাহিত্য
২. ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ইশারায় বলে দিন
৩. না সাহিত্যে গােপনতা বা চতুরতা বলে কিছু নেই। মূত্রস্থলী টন করলে আমরা দেয়ালের বা ঝােপের আড়াল খুঁজি না।

এদের পত্রিকার সূচনা পৃষ্ঠার শীর্ষদেশে ইংরেজি ভাষায় লেখা হতো 

‘No literature Little Beatle Literature Literature A piquant poigrant and Penetrating Kaledeoscope—Stireing the Conventional and Conformist Literary Arena in Doldrums’.

এঁরা ‘নিম সাহিত্য প্রসঙ্গে বলেছেন —
১। নিম গল্পই মানুষের একমাত্র বজ্ৰমেরুদণ্ড।

২। লেখকের লেখনী থেকে কখনাে বেরােয় তিক্ত বিরক্ত গরল ভেদবমি কখনাে কটু প্রস্রাব আবার কখনাে মাতৃস্তন্যের মত ধবল দুধের ধারা। মানুষের সুখের ভাষা আর হাতের কলম আজ সমান শক্তিশালী।

আরো পড়ুন :  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও দুর্গাপূজা, লিখেছেন অরিন্দম ঘোষাল
৩। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আকাশের চেহারার মত মানুষের সুখের রঙও পাল্টায়।

৪। জীবনের কোন ব্যাখ্যা নেই কার্য কারণের ভবিষ্যৎ নেই জীবনের কোনধ ধর্ম নেই কার্যকারণের কোনো ব্যাখ্যা নেই।

৫। নিমভাষায় গদ্যছন্দ বলে কোন কথা নেই, যখন যা কিছুর দ্বারা সংক্রামিত গু মুত থুতু লালা অগ্নি গরল রক্ত প্রেম হিংসা সাহিত্যের শরীরে লেপে দিন।

নিম সাহিত্যের বয়ান দ্বাদশ সংখ্যায় (মার্চ ১৯৭২) ১০টি সূত্রে এঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন তা এইরকম :

ক. ঠিকঠাক ঘটে না কিছুই…
খ. জীবনের কোনো ধর্ম নেই যা কিছু স্রেফ ধাঁ ধাঁ। মস্তিষ্ক ও হৃদয় বিসর্জন দিন এবং নারী ফুল চাঁদ ইত্যাদি ইত্যাদি।
গ. ব্যারেলের উপর থেকে প্রজাপতিটা উড়িয়ে দিন ( রোমান্টিক ঘুঘুরা সাবধান ]।

ঘ. নিজের মগজের ফাংগাস নিজেই উপডে ফেলুন, সভ্যতার দাঁতে ভয়ংকর বিষ ( অখচ শক্তিপদ রাজগুরু ‘ভগবান সজ্জন’)।
ঙ. সাহিত্যের ঐতিহ্য বাতি হয়ে গেছে জীবনেরও আর কোনো ঐতিহ্য নেই। [ কিন্তু গীনসবার্গ বাংলাদেশের জন্য কয়েক শত ডলার পারলৌকিক কার্যে দান করেছেন।]
চ. কালীমার্কা ফিনাইলে সাহিত্যের দুর্গন্ধ দূর হয় না। বােধের মূলে নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করুন। [ সত্তর দশকের বাংলা উপন্যাস তৃণভূমি, ঘুণপােকা, কোয়েলের কাছে, নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে-বাংলা সাহিত্যের Flitch. ]
ছ. সাহিত্যে সাহিত্য সুনীতি নিষ্প্রয়োজন। এখন যা কিছু তা ব্যক্তিগত বিস্ফোরণ। [ যেহেতু এখন চতুর্দিকে অবিরাম শব্দ শব্দ শব্দ শব্দ শব্দ)

জ. লেখক হওয়ার বাসনা জাগামাত্রই আত্মহত্যা করুন। (কমল মজুমদার আত্মহত্যা করেছেন বলে আমরা মনে করি না। ]

ঝ. সবাই লিখবেন না কেউ কেউ লিখুন এবং যা কিছু বিরক্তকর তাই লিখুন [ তবুও ডাক্তার নীহাররঞ্জনের গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা রহস্যময়ভাবে বেড়েই চলেছে। ]
ঞ. কালাে চশমা খুলে ফেলুন। সূর্যের দিকে সরাসরি তাকান। ক্যালভেরী পাহাড়ের যিশু, টেক্সাসের যিশু, চট্টগ্রামের যিশু, দুর্গাপুরের যিশু — সূর্যটা সরাসরি

পৃথিবীর দিকে নেমে আসছে। ]

নিম সাহিত্যের গদ্য আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন মুখ্যত সুধাংশু সেন, রবীন্দ্র গুহ, বিমান চট্টোপাধ্যায় ও মৃণাল বণিক। উদয়ন ঘােষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বারীন ঘোষাল, অরুণেশ ঘােষ, সুবাে আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, অজয় নন্দী, নৃসিংহ রায়, প্রিতম মুখােপাধ্যায় প্রমুখরাও লিখেছেন নানা সংখ্যায়।

আরো পড়ুন :  সংগ্রামী রাসবিহারী বসু ও এক জাপানি কন্যার প্রেমকথা, কল্যাণ চক্রবর্তী

——————————————————————

———————— ——————————————

ঋণ : সন্দীপ দত্ত         


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *