রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ-সাজাদপুর অবস্থানকালে যেসব গল্প রচিত হয়েছিল তার অধিকাংশের উৎস সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের একাধিক চিঠি পাওয়া যায়। গল্পগুচ্ছের বহু গল্পের উপাদান রবীন্দ্রনাথ পদ্মা-তীরবর্তী গ্রামগুলিতে পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিও ব্যতিক্রম নয়। গল্পটির উৎস খুঁজতে গেলে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে অন্তত ২টি চিঠির সন্ধান পাওয়া যাবে যেখানে কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পটির কাহিনির সূত্র সম্বন্ধে অকপটে স্বীকারোক্তি  করছেন। চিঠি ২-টির ক্রমিক সংখ্যা- ১৭ এবং ৬২।

[ads id=”ads1″]
রবীন্দ্রনাথ যখন সাজাদপুরে অবস্থান করছিলেন তখন প্রায়ই গল্প করতেন ওখানকার পোস্টমাস্টার মহেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সাজাদপুরের কুঠিবাড়িতে একদিন গল্পের আসরে পোস্টমাস্টার গল্প করছেন কবির সঙ্গে, তিনি বলছিলেন তাঁদের দেশের জনসাধারণের গঙ্গার উপর এমন ভক্তি যে, তাদের কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু হলে তার হাড় গুঁড়ো করে রেখে দেয়। তারপর গঙ্গাজল খেয়েছে এমন লোকের দেখা পেলেই ঐ হাড়ের গুঁড়ো পানের সঙ্গে তাকে খাইয়ে দেয় এবং এতেই তার আত্মীয়ের গঙ্গালাভ হলো বলে তারা মনে করে। [দ্রষ্টব্য- ছিন্নপত্রাবলী- ১৭ নং পত্র]

আরো পড়ুন :  শৌখিন নাট্যাভিনয়ে বাঙালি মনীষী [প্রথম ভাগ]

পোস্টমাস্টার মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে কবির বেশ অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। ছিন্নপত্রের ছিঠিতেই এর সমর্থন মেলে-

তোকে চিঠিতে লিখেছিলেম কাল 7 p.m.’এর সময় কবি কালিদাসের সঙ্গে একটা এন্‌গেজ্‌মেন্ট্‌ করা যাবে। বাতিটি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে কাদারাটি টেনে যখন বেশ প্রস্তুত হয়ে বসেছি, হেনকালে কবি কালিদাসের পরিবর্তে এখানকার পোস্টমাস্টার এসে উপস্থিত। মৃত কবির চেয়ে একজন জীবিত পোস্ট্‌মাস্টারের দাবি ঢের বেশি–…….অতএব পোস্টমাস্টারকে চৌকিটি ছেড়ে দিয়ে কালিদাসকে আস্তে আস্তে বিদায় নিতে হল। [দ্রষ্টব্য- ছিন্নপত্রাবলী- ৬২ নং পত্র]

পোস্টমাস্টার মহেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের ব্যাপারটি এবার বলা যাক। একবার আগুন লেগে সাজাদপুরের পোস্টঅফিস পুড়ে যায়, তখন সাময়িকভাবে পোস্টঅফিসটি রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির একতলায় স্থানান্তরিত হয়। রবীন্দ্রনাথের কোনো চিঠি এলে পোস্টমাস্টার মহেন্দ্রবাবু নিজেইসেই চিঠি স্বয়ং দিতে আসতেন। এইভাবে সামান্য পোস্টমাস্টারের সঙ্গে বিখ্যাত মনীষীর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।

আরো পড়ুন :  মনিয়া প্রসঙ্গ ও জীবনানন্দ, অপব্যাখ্যার নিরসন
কবি রবীন্দ্রনাথ সময়ে অসময়ে পোস্টমাস্টারকে ডেকে গল্প করতেন অবসর বিনোদনের জন্য। পোস্টমাস্টারও একটু ফাঁক পেলেই ছুটে আসতেন সদালাপী ভাবুকচিত্ত কবির কাছে। মহেন্দ্রবাবু ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মতোই তরুণ। তিনিও ছিলেন কলকাতার ছেলে। কাজেই মহেন্দ্রবাবু অনেকসময় ঘনিষ্ঠ আলাপ করার সুযোগ পেতেন কবির সঙ্গে। তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার, মা-ভাই-বোনের গল্প কোনোটাই বাদ পড়তো না। শাজাদপুরে এসে মহেন্দ্রবাবু নিজেকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো মনে করতেন নিজেকে। মনে শান্তি ছিল না। তিনি সকল সময় চাইতেন কলকাতায় ফিরে যেতে। তাঁর মনে হতো ছুটি নিয়ে চলে যান বা চাকরিতে ইস্তফা দিতে চাইতেন। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের কাছে এসব কথা দুঃখ করে বলতেন। এখানে উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথের চেষ্টাতেই তাঁর বদলির ব্যবস্থা হয়েছিল।
[ads id=”ads2″]
সাজাদপুরের এই পোস্টমাস্টার মহেন্দ্রবাবুকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি লিখেছিলেন। ইন্দিরা দেবীকে লিখিত ছিঠিতে তার স্বীকারক্তি রয়েছে-

যখন  আমাদের এই কুঠিবাড়ির একতলাতেই পোস্ট অফিস ছিল এবং আমি এঁকে [মহেন্দ্রবাবু] প্রতিদিন দেখতে পেতুম, তখনি আমি একদিন দুপুর বেলায় এই দোতলায় বসে সেই পোস্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম, এবং সে গল্পটি যখন হিতবাদীতে বেরোল তখন আমাদের পোস্টমাস্টারবাবু তার উল্লেখ করে বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্য বিস্তার করেছিলেন। [ছিন্নপত্রাবলীর ৬২ নং পত্র] 

আরো পড়ুন :  রবীন্দ্র-জীবনের শেষ বৎসর, শান্তিদেব ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *