ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো | রবীন্দ্রনাথের বিজয়া রবীন্দ্র-কবিতার মাঝে

রবীন্দ্রনাথের গানের জগতে ‘বিদেশিনী’ শব্দটি অর্থবহ। ৩৫ বছর বয়সে কবি একটি গান লিখেছিলেন–
আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী।
(২৫ আশ্বিন ১৩০২)
[ads id=”ads1″]
গানটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। শুধু তাই নয়, কবি এই গানটির ইংরেজি অনুবাদ ভিক্টোরিয়ার (কবির আদরের ‘বিজয়া) হাতে তুলে দেন। উক্ত্য গানের শেষ চরণ–“আমি অতিথি তোমারি দ্বারে, ওগো বিদেশিনী’। রবীন্দ্রনাথ গানের ‘অতিথি’ শব্দটির সাদৃশ্যে ‘অতিথি’ কবিতা লিখলেন :
প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,
মাধুর্য সুধায় কত সহজে করিলে আপনারি
দূরদেশী পথিকেরে;
*******************************
প্রেমের অতিথি কবি, চিরদিন আমারি অতিথি
—এখানে উল্লেখ্য বুয়েনাস আইরেসে কবি ২৬টি কবিতা লিখেছিলেন, তার মধ্যে ১৪টি কবিতা বিশেষভাবে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১] বিদেশি ফুল ২] অতিথি ৩] অন্তর্হিতা ৪] আশঙ্কা ৫] শেষ বসন্ত ৬] বিপাশা ৭] চাবি ৮] প্রভাতী ৯] মধু ১০] অ-দেখা ১১] চঞ্চল ১২] প্রবাহিণী ১৩] না-পাওয়া ১৪] বনস্পতি—এই ১৪টি কবিতায় ভিক্টোরিয়ার প্রতি কবির অনুভূতি সরাসরি প্রকাশ পেয়েছে।
ভিক্টোরিয়া জন্মসূত্রে দক্ষিণ আমেরিকায় অধিবাসিনী, কিন্তু দীক্ষাসূত্রে ভারতকন্যা। তাঁর দুই গুরু–মহাত্মা গান্ধী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অকুণ্ঠ ভাষায় ভিক্টোরিয়া জানিয়েছেন:
The wisdom, which in my case is not wisdom but rather felling, and institution, I owe in great part to two men born in a distant land, belonging to a civilisation and  a race apparently different from mine (if not in their roots at least in their branches) : Gandhiji and Gurudev. The former I saw and heard only once, in 1931. As to the letter, to my lasting happiness, our paths were to cross and intermingle.
ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে কবির যখন প্রথম দেখা হয় তখন কবির বয়স সাড়ে ৬৩, ভিক্টোরিয়া সাড়ে ৩৪। রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার প্রিয়কবি, কেননা রবীন্দ্রনাথের “গীতাঞ্জলি” তাঁর এক আধ্যাত্মিক সংকটে তাঁর মনকে সান্ত্বনা ও আশ্রয় দিয়েছিল। যাইহোক রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভিক্টোরিয়ার অনুভূতিকে আমাদের অলঙ্কারকৌস্তুভের ভাষায় বলা যেতে পারে “ভাবরতি”।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তাঁর প্রিয়-কবির মধ্যে একটি শিশু সত্তাকে আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বলেছেন, কোন কোন দিক দিয়ে কবি ছিলেন একেবারে শিশুর মতো। “In some ways Tagore was live a child.” শুধু তাই নয়, বয়সে তাঁর পিতার সমান এই বিদেশী কবির প্রতি তিনি মাতৃসুলভ কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ হতেন; এবং কখনো কখনো শিশুর মতোই গ্রহণ করতেন। 
সমুদ্রযাত্রায় কবি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই বুয়োনেস আইরেসে দু’মাস থেকেছিলেন। এই দিনগুলি ভিক্টোরিয়ার জীবনে পরম আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। তিনি মনোভাব প্রকাশ করে বলেছিলেন,

To say I did not bless the ‘Flu’ in spite of the concern it caused me, would be a lie.

ভিক্টোরিয়াকে উপলক্ষ করে লেখা প্রেমের কবিতাগুলির মধ্যে ‘শেষ বসন্ত’ কবিতাটি সম্পর্কে বলা যায়, এই কবিতায় কবির অনুভূতি যেমন অকুণ্ঠ তেমই আবেগঘন। কবি বলেছেন,
বেলা কবে গিয়াছে বৃথাই
এতকাল ভুলেছিনু তাই
হঠাৎ তোমার চোখে
দেখিয়াছি সন্ধ্যালোকে
আমার সময় আর নাই।
************
রাত্রি যবে হবে অন্ধকার
বাতায়নে বসিয়ো তোমার।
সব ছেড়ে যাব প্রিয়ে,
সুমুখের পথ দিয়ে,
ফিরে দেখা হবে না তো আর ।
কবি বলেছেন “ফিরে দেখা হবে না তো আর”, কিন্তু ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে কবির দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৩০ সালে।
“মহুয়া” কাব্যে নতুন বৌঠান, রাণু এবং ভিক্টোরিয়ার আবির্ভাব কল্পনা করা অস্বাভাবিক নয়। এই কাব্যের একাধিক কবিতায় ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি জড়িয়ে আছে; অসমাপ্ত, দূত, বাপী, প্রচ্ছন্না, দিনান্তে প্রভৃতি কবিতায় ভিক্টোরিয়ার কথা ফিরে এসেছে।
“পরিশেষ” কাব্যের অন্তত দুটি কবিতা– নির্বাক আর ভীরু–ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ভীরু কবিতার অংশবিশেষ-
তাকিয়ে দেখি পিছে
যেদিন ভালো বেসেছিলেম,
দিন না যেতেই হয়ে গেল মিছে।
রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতার শেষ সংকলন, “সানাই”। আলোচ্য কাব্যের অধরা, কৃপণা, দেওয়া-নেওয়া, শেষকথা, আধোজাগা, উদ্ধৃত, হঠাৎ মিলন, দূরবর্তিনী, আত্মছলনা, মানসী (দ্বিতীয়) — কবিতাগুলি ওকাম্পোর সঙ্গে যুক্ত। “দেওয়া-নেওয়া” কবিতায় আছে-
বাদল দিনের প্রথম কদমফুল
আমায় করেছ দান
আমি তো দিয়েছি ভরাশ্রাবণের
মেঘমলার গান।
বলাই বাহুল্য দেওয়া-নেওয়ার এই অনুষঙ্গে মেঘমল্লার গানেরই জয়জয়কার। কবি যা পেলেন তা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তিনি যা দিলেন তা চিরকালীন। দানের এই গরিমাই তাঁর প্রেমের পরম গৌরব।
———————
জগদীশ ভট্টাচার্য
কবিমানসী ২য়
———————
 
   
 

আরো পড়ুন :  চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম, লিখেছেন আব্দুর রহমান আনসারী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *