শরৎচন্দ্র ও নাটক প্রসঙ্গ
প্রথম পর্ব
শরৎচন্দ্র ছেলেবেলায় গান-বাজনা, অভিনয় প্রভৃতি বিষয় খুব উৎসাহী ছিলেন। একদিকে যেমন ছিল তাঁর সুকণ্ঠ, তেমনি ছিল তাঁর অভিনয়-নৈপুণ্য। এই দিকের জীবনের পরিচয় স্বরূপ কিছু তথ্য দেওয়া হল –
শরৎচন্দ্রের বন্ধু সতীশচন্দ্র (ভাগলপুরের উকিল শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র) "আদমপুর ক্লাব" নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবের একটি ড্রামাটিক সেকশন ছিল এবং বাংলা নাটক অভিনয় করা ছিল এই ক্লাবের বৈশিষ্ট্য। এই ক্লাব আয়োজিত মৃণালিনী, বিল্বমঙ্গল, জনা নাটকের অভিনয়ে শরৎচন্দ্র যথাক্রমে মৃণালিনী, চিন্তামণি ও জনার ভূমিকায় অভিনয় করেন।
[যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্রের বাল্য কাহিনী, বাতায়ন, শরৎ-স্মৃতি-সংখ্যা, ২৬ ফাগুন ১৩৪৪]
শুধু নাটক অভিনয় নয়, নাটক রচনার দিকেও শরৎচন্দ্রের প্রবণতা ছিল। একটি পত্রে তার উল্লেখ রয়েছে —
প্রমথ, আমিও একটা নাটক লিখব বলে ঠিক করেছি। যদি ভাল হয় (হবেই!) কোন theatre-এ প্লে করিয়ে দিতে পার ? এই পর্যন্ত।
[প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে লিখিত পত্র, রেঙ্গুন, ডাকমোহর ৮ এপ্রিল ১৯১৩]
যাইহোক থিয়েটার সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রের যে উচ্চ ভাবনা ছিল তা উল্লেখ্য। একটি প্রবন্ধে বলেছেন —
সর্বদেশে সর্বকালে থিয়েটার জিনিসটা কেবল আনন্দ নয়, লোকশিক্ষায়ও সাহায্য করে।
[সত্য ও মিথ্যা, বাঙ্গলার কথা, ২০ মাঘ ও ৫ ফাল্গুন ১৩২৮]
শরৎচন্দ্র কোনো মৌলিক নাটক লেখেননি। তাঁর বহুল পরিচিত কয়েকটি উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন তিনি। তিনটি উপন্যাসকে নাটক-এ রূপান্তরিত করেন এবং উপন্যাসের নায়িকাদের নামেই নাটকের নাম দেন।
- ক) দেনাপাওনা – ষোড়শী
- খ) পল্লীসমাজ – রমা
- গ) দত্তা — বিজয়া
দেনাপাওনা উপন্যাসের নাট্যরূপ : ষোড়শী
- দেনাপাওনা উপন্যাসের নাট্যরূপ।
- প্রকাশকাল আগস্ট ১৯২৭।
- শিশির কুমার ভাদুড়ী প্রতিষ্ঠিত নাট্যমন্দিরে প্রথম অভিনীত হয়, ২১ শ্রাবণ ১৩৩৪।
মূল উপন্যাসের পরিণতি ও নাটকের পরিণতির মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। উপন্যাসের শেষাংশ মধুর কিন্তু নাটকের শেষাংশে ট্রাজেডির সুর ধ্বনিত হয়। উল্লেখ্য নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের অনুরোধেই শরৎচন্দ্র এই পরিবর্তন করেন।
“ষোড়শী” নাটক খানি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে যে চিঠিখানি পেয়েছিলেন তার একটি অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
ষোড়শীতে তুমি উপস্থিত কালকে খুশি করতে চেয়েচ, এবং তার দামও পেয়েচ। কিন্তু নিজের শক্তির গৌরবকে ক্ষুন্ন করেচ। যে ষোড়শীকে এঁকেচ সে এখনকার কালের ফরমাসের, মনগড়া জিনিস, সে অন্তরে বাহিরে সত্য নয়।
[৪ ফাল্গুন ১৩৩৪]
এর উত্তরে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন –
উপস্থিত কালটাও যে মস্ত ব্যাপার, তার দাবি মানবো না বললে, সেও যে শাস্তি দেয়।
[সামতাবেড়, ২৬ ফাগুন ১৩৩৪]
দেনাপাওনা-র নাট্যরূপ নিয়ে বিতর্ক
‘দেনাপাওনা’র নাট্যরূপ কে দেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শরৎচন্দ্র কর্তৃক মনীন্দ্র রায়কে লিখিত পত্রে (১ জুন ১৯২৭] জানা যায়, শিবরাম চক্রবর্তী এর প্রাথমিক নাট্যরূপ দেন। (এছাড়াও শরৎচন্দ্র, শিবরাম, শিশিরকুমার নিয়ে অনেক দুঃখজনক ঘটনা রয়েছে, সে বিষয় এখানে অনালোচিত থাকলো)
পল্লীসমাজ উপন্যাসের নাট্যরূপ : রমা
- “পল্লীসমাজ” উপন্যাসের নাট্যরূপ।
- প্রকাশকাল আগস্ট ১৯২৮।
- আর্ট থিয়েটার কর্তৃক স্টার রঙ্গমঞ্চে প্রথম অভিনয়, ১৯ শ্রাবণ ১৩৩৫।
- পরবর্তীতে শিশিরকুমারের নাট্যমন্দিরেও অভিনীত হয়েছিল।
দত্তা উপন্যাসের নাট্যরূপ : বিজয়া
- “দত্তা” উপন্যাসের নাট্যরূপ।
- প্রকাশকাল ডিসেম্বর ১৯৩৪।
- স্টার রঙ্গমঞ্চে শিশিরকুমারের নাট্যমন্দির কর্তৃক প্রথম অভিনীত হয়, ৬ পৌষ ১৩৪১।
আলোচ্য তিনখানি নাটক ছাড়াও শিশিরকুমারের অনুরোধে আরো দুখানি নাটক রচনা করেছেন শরৎচন্দ্র কিন্তু দুটোই সমাপ্ত করতে পারেননি।
- এক – নববিধান
- দুই – অচলা (গৃহদাহের নাট্যরূপ)
নাটক দুখানি শেষ করতে না পারার কারণ যথাক্রমে, শিশিরকুমারের অসুস্থতা ও শরৎচন্দ্রের নিজের ভয়ানক অসুস্থতা। যদিও শিশিরকুমার “অচলা”কে মঞ্চস্থ করার অভিপ্রাযয়ে অসমাপ্ত নাটকটিকে যতীন্দ্রনাথ রায়কে দিয়ে লেখান এবং সেই নাটক মঞ্চস্থ করেন। এ নিয়ে শরৎচন্দ্র আক্ষেপ করে বলেছিলেন,
শিশির আমার অচলার 'আকার'টা লোপ করে দিয়েছে।
[অবিনাশচন্দ্র ঘোষালের সঙ্গে কথোপকথন সূত্রে]
“বিরাজ বৌ” নিয়ে বিতর্ক
অনেকেই বলেন ‘বিরাজ বৌ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ শরৎচন্দ্র দেন কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল। এবং এই ভুলের কারণ হলো, “বিরাজ বৌ” যখন নাটক হিসেবে মুদ্রিত হয় তখন নাট্যরূপদাতার নাম ছিল না, শুধু উপন্যাস লেখকের নাম ছাপা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে প্রথম অভিনয়ের সময় এর নাট্যরূপ দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ; পরবর্তীতে শিশিরকুমার নিজের নাট্যমন্দিরে অভিনয়ের জন্য ‘বিরাজ বৌ’ নতুনভাবে তিনি লেখেন। আর এটি যখন মুদ্রিত হয় তখন শিশিরকুমারের নাম উল্লেখ করা হয়নি। বর্তমানে “বিরাজ বৌ” নাটকের যে পাঠ প্রচলিত তা প্রস্তুত করেছিলেন (লিখেছিলেন) কানাই বসু।
দ্বিতীয় পর্ব
শরৎচন্দ্র-এর কাহিনি নিয়ে আর যাঁরা যা লিখেছেন তা পরপর উল্লেখ করা হলো –
- চরিত্রহীন — যোগেশচন্দ্র চৌধুরী
- চন্দ্রনাথ — বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
- বামুনের মেয়ে — অবিনাশ চন্দ্র ঘোষাল
- গৃহদাহ — ঐ
- পণ্ডিতমশাই — ঐ
- দেবদাস — শচীন সেনগুপ্ত
- পথের দাবী — ঐ
- স্বামী — দেবনারায়ণ গুপ্ত
- রাজলক্ষ্মী — ঐ
- শ্রীকান্ত — ঐ
- বিন্দুর ছেলে — ঐ
- রামের সুমতি — ঐ
- অনুপমার প্রেম — ঐ
- নিষ্কৃতি — ঐ
- কাশীনাথ — ঐ
- পরিণীতা — ঐ
ঋণ - অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল