বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি আলি রাজার বৈষ্ণব পদ

বাংলা ভাষায় রচিত বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবির বৈষ্ণব পদ সংকলন খুব একটা বেশি নেই। এ বিষয়ে প্রথম এবং শেষ বৃহৎ কাজটি করেছেন যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। আমরা পর্বে পর্বে চেষ্টা করব বিভিন্ন মুসলমান কবির রচিত বৈষ্ণব কবিতা তুলে ধরার। আজ কবি আলি রাজার ১৩টি পদ উল্লেখ করা হলো।
 


বৈষ্ণব পদকর্তা আলি রাজ৷

।। ১ ।।

গীত ধানশী

বংশী

অখণ্ড মহিম৷ যার নাহিক তুলন।

*****************

 যার নাম বেদশাস্ত্র অক্ষরে না ধরে। 

পরম বংশীর স্বনে সে নাম নিঃসরে ॥ 

সাহা কেয়ামদ্দিন গুরু বংশীনাদে বশ। 

আলি রাজা কহে বাশী অমূল্য পরশ ॥

।। ২ ।।

গৌরী

বিরহ

আজুক৷ না পারি নারী ঘুমাইতে ঘর,

পন্থ হেরি বিরহিনী কান্দে ঝর ঝর ॥ ধু

আচম্বিত প্রিয়-ভাব উঠিলেক মনে ।

যেমত লাগিল অগ্নি গহন কাননে ॥

অপার বিরহ যত করিল লাঘব।

সে দুঃখ কহিতে কাছে নাহিক বান্ধব ॥

বিরহবেদনা দুঃখ আলিরাজা গাএ ।

প্রেম-যন্ত্র যার মনে সেই পতি পাএ ॥

।। ৩ ।।

বিভাস

বিরহ


আজু কেন অন্ধকার বদন চান্দ ॥ ধু

জ্যোতিহীন দেখি মুখ,

বিদরে দারুণ বুক,

শিরেতে লাগিল বজ্রাঘাত ৷

কোন দুঃখে মনে দাগ,

দান দিমু যেই মাগ,

হাসি বাঁশী ফুক হরিনাথ ।

যদি হরি মধু হাসে,

কোটি জন্ম পাপ নাশে,

বিরাহিনী বাঞ্ছা হয় পূর ।

পদ্মনাভ জগস্বামী,

নধর যৌবনী আমি,

সেইপদ নিছনি যাম্ দূর ।

গুক রূপা সিন্ধু জলে,

হীন আলিরাজা বোলে,

প্রেম হেতু গোপাল বিকল ।

ভেদ নাহি রাধা কানু,

জর জর যুগ তনু,

আরো পড়ুন :  প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে দূতী-সহচরী, সুখেন মণ্ডল

সহে দুঃখ বিরহ আনল ॥



।। ৪ ।।

বড়ারি

বিরহ


আমি কালার বিরহিনী জগতের মাঝে ॥ ধু

বিরহিণী প্রেম-দুঃখ সহে যেই মতে,

সে দুঃখের দোষ গুণ না জানে জগতে ॥

সংসারের সুখ-ভোগ সব করি নাশ,

কায় মনে পিরীতি সেবিতে মোর আশ।

আপনা বিনাশ যদি ‘ভাব’কে না করে,

প্রেম সিদ্ধি মন-বাঞ্ছ৷ ফল নাহি ধরে ॥

আলি রাজা ভণে সার সেবি প্রেমানল,

আপ্ত নাশ করি পায় প্রেম সিদ্ধি ফল ॥



।। ৫ ।।

ললিত

অনুরাগ


এই মাগি শ্যাম পায় অবলা মনে ॥ ধু ।

হেন সাধ করে মনে প্রিয় লাগ পাস্,

চক্ষুর পোতল আড়ে সে নিধি লুকাস্॥

দেখি দেখি নয়ানের সাধ না পূরায়,

শুনি কর্ণে মধুবাক্য শান্তি নাহি পায় ৷

নয়ান অন্তরে রাখি দেখি নিরন্তর,

হৃদের কমলরসে রাখিতে ভ্রমর ॥

আলি রাজা ভণে অই গীত নিশি দিন,

শ্যাম পদে শ্রদ্ধা এই—যেন জলে মীন ॥



।। ৬ ।।


শুদ্ধ মালৰ

বিরহ

এ মোর করম দশা।

স্বামীর চরণ, ভজিয়া না সেবিলুম, না পূরিল মোর আশা ॥ ধু

জগতে জনমিলুম্, পাছে না চিন্তিলুম্, যৌবন হইল ক্ষীণ।

মোর হত কর্ম, বৃথা গেল জন্ম, স্বামীপদে হৈনু ভিন।।

ঘরে ছিল স্বামী, লাজেত বিভ্রমি, ডুবিনু অকর্ম রসে ।

এ রূপ যৌবন, সব অকারণ, অভাগিনী কর্ম দোষে ॥

গুরুর চরণে, আলি রাজা ভণে, অদ্যপি না তেজ আশ ৷

স্বামী দাত৷ তন, যে লয় শরণ, কপালে না তেজ দাস ॥



।। ৭ ।।

দেশকারী

বিরহ


ঐ সে উঠে মনে মোর স্বপনে,

দেখিলুম চন্দ্র হর নব ঘনে ॥ ধু

আরো পড়ুন :  চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের চরিত্র পরিচিতি

ত্রিলোক মোহিনী রূপ দেখিনু যাহার,

বসিল মনের চক্ষে তেজিনু সংসার ।

অপূর্ব দেখিনু যারে কমল ভ্রমরা,

সততে উথলে মনে না যায় পাসরা ॥

আলি রাজা ভণে রূপ সর্ব সিদ্ধি মুনি,

এ রূপ যৌবন মোর সে রূপ নিছনি ॥


।। ৮ ।।

কেদার

বিরহ


কমল চরণে ঠাঁই মাগম্ সততে, তুয়া বিনু প্রাণেশ্বর নাহিক জগতে ৷ ধু

অবলা কুমারী আমি, সূক্ষ্ম তন্থ জগস্বামী, অই দুঃখ মরমে বিশেষ ।

কামিনী শরীর পীন, কামানলে রাত্রিদিন, তন্ত্র দহে পিয়া পর দেশ ॥

প্রাণনাথ বুলি ডাকি, নিত্য পন্থ হেরি থাকি, কতদিনে দরশন পাম্।

স্বামীকে না দেখি পাশ, বিষপ্রায় গৃহবাস, পিয়ার উদ্দেশে শ্রদ্ধা যাম্॥

পিরীতি রতন মূলে, হীন আলি রাজ৷ বোলে, প্রাণসখা পদে ব্রত করি।

কেদার হেমন্ত ঘরে, বঞ্চে নিত্য প্রিয়েশ্বরে, বসন্ত হইল প্রাণ বৈরী ॥



।। ৯ ।।

মালশী

বিবিধ


করুণাদধি কালার বরণী শ্যামা কালী ॥ ধু ।

তুমি নারায়ণ হরি, তুমি হর ব্রহ্মা গৌরী, দেবের দেবতা তুয়া মূল ৷

অষ্টলোকে পরিহার, রাতুল চরণে যার, শরণ মাগে সব দেব কুল ॥

তুমি গুরু মাতা পিতা, ত্রিলোক পরম দাতা, তারিণী করুণাসিন্ধু সার ।

জগত রুদ্রাণী তনু, শিব লীলা রাধা কানু, সত্ত্ব রজঃ তমঃ শক্তি যার ॥

হীন আলি রাজা বোলে, শ্যামা কালী পদতলে, শক্তিলীলা শঙ্কর ঘরণী। 

সূর বংশী হর গৌরী, চন্দ্র অংশী রাধা হরি, তত্ত্বরূপী নবীন যৌবনী ॥



।। ১০ ।।

আশোয়ারী

প্রেমোন্মাদ


কানু বিনে রাধার না লয় আন চিত,

জগতের কায় মনে যার যন্ত্র গীত ৷ ধু

প্রেম বিনু রাধাএ না জানে কোন কাম,

আরো পড়ুন :  চৈতন্যদেবের জীবনের কালপঞ্জি

অষ্ট অঙ্গে রাধার নিঃশ্বরে শ্যাম নাম ॥

ভক্ষ্য নিদ্রা ত্যজি রাধা শ্রাম প্রেমে বশ,

সততে হরির সেবা অমূল্য পরশ।

গুরুর চরণে হীন আলি রাজা ভণে,

জন্মে জন্মে ভক্ত রাধা হরির চরণে ॥


।। ১১ ।।

গঁড়া

বিরহ

কালা তোমা ভাল জানি,

তোমার সঙ্গে প্রেম করি হৈলুম কলঙ্কিনী। ধু

দেখা দিয়া গেলা প্রিয়ে হৈল কত কাল,

কেমতে রহিলা মোরে দিয়া মায়া জাল ।।

হেন সাধ মনে মোর করি কণ্ঠ হার,

ভ্রমর কমলে রাখি হৃদের মাঝার।

হীন আলি রাজা কহে ভজি গুরুপায়,

এই মাগি পিয়৷ পদে দেখিতে সদায় ॥



।। ১২ ।।

কুমারী

পূর্বরাগ


কি খেনে আসিলাম ঘাটে।

নন্দের নন্দন, ভুবনমোহন, দেখিয়া মরম ফাটে ॥ ধু

পদ্মনাভ কদম্ব শিখরে বসি,

করে বেণু ঝাঁঝর বদনে পুরে বাঁশী ৷

যেরূপ দর্শনে ভ্রমে ইন্দ্র সূর শশী,

যেরূপ স্মরণে ডুবি মজিল তপস্বী ॥

যেরূপ দেখিয়৷ রাধা হৈল উদাসিনী,

লাজ ভয় ধর্ম তেজি শ্যাম কলঙ্কিনী।

আলি রাজা গাহে প্রেম রতন উত্তম,

***************** ।।



।। ১৩ ।।

দীপক

রূপ


কি রূপ দেখিনু সই সই, অই না যায় পাস্রা‌। ধু

সেইরূপ হইল নারীর প্রাণ-কাল,

হরিল জীবন মোর বুকে দিয়া শাল ॥

লেখিল পাষাণে রূপ বজ্রের সমান,

ক্ষুধা নিদ্রা হরিল হরিল লাজ মান ॥

হীন আলি রাজা কহে সেইরূপ বিনে ॥





————————————-

ঋণ – যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য

————————————–


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *