বাংলা লিপির ইতিকথা, History of Bengali Script, সুভাষ ভট্টাচার্য
বাংলা লিপির ইতিকথা
লেখক – সুভাষ ভট্টাচার্য
সাদামাটা হিসেবে লিপির বয়স ছ-হাজার বছরের মতো। কাজেই মুখের ভাষার তুলনায় লিপি নিতান্তই নবীন। লিপির উদ্ভব হয়েছিল মুখের ভাষার চিত্ররূপ হিসেবে। তবে সেই লিপি নিঃসন্দেহে মুখের ভাষার অপূর্ণাঙ্গ দৃশ্যরূপ। প্রাচীনতম লিপি হল চিত্রলিপি (pictogram)। পাহাড়ে-কন্দরে বা গুহার পাথরের গায়ে যে-ছবি এঁকে আদিম মানুষ তার মনোভাব প্রকাশ করত, তা-ই চিত্রলিপি। চিত্রলিপি চামড়াতেও আঁকা হত। আদিম চিত্রলিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে মেক্সিকোয় এবং উত্তর ও মধ্য আমেরিকার আদিম উপজাতিসমূহের অঙ্কনে। লিপি পরবর্তী ধাপগুলো হল ভাবলিপি (ideogram), চিত্রপ্রতীকলিপি (hieroglyph), ধ্বনিলিপি (phonogram) শব্দলিপি (logogram),অক্ষরলিপি (syllabic script), বর্ণলিপি (alphabetic script)I যেখানে চিত্রলিপিতে কেবল বস্তুর প্রতি নির্দেশ থাকত, সেখানে ভাবলিপিতে ‘ভাব’ও বোঝানো হত– হাসি, দুঃখ, চিন্তা ইত্যাদি। কোনও কোনও ভাষাতাত্ত্বিক ভাবলিপিকে ‘ideogram’ না-বলে ‘logogram’ বলেন, যদিও শব্দলিপিই ‘logogram’-এর সঠিক পরিভাষা মনে হয়। আদিতম ভাবলিপির নমুনা পাওয়া গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় এবং অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার আদিম উপজাতি সমূহের অঙ্কনে। এর পরেই এল চিত্রপ্রতীকলিপি যার দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে কীলক লিপিতে (cuneiform) ও মিশরের হাইয়েরোগ্নিফিক্স-এ বা পবিত্রলিপিতে। এর কোনওটিতেই ধ্বনিকে বোঝাবার ব্যবস্থা ছিল না। তাই আরও পরবর্তী সময়ে উন্নততর ধ্বনিলিপি (phonogram) উদ্ভাবনের চেষ্টা চলতে থাকে। ধ্বনিলিপি ও অক্ষরলিপির স্তর পেরিয়ে কিংবা তাকে উন্নততর করে এল বর্ণমালা। এইখানে এসে লিপি নতুন অর্থ ও তাৎপর্য পরিগ্রহ করল।
বর্ণমালার উদ্ভাবক সম্ভবত ফিনিশীয়রা। তাদের বর্ণমালায় স্বরবর্ণ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সবই ব্যঞ্জনবর্ণ। যে-লিপিতে ফিনিশীয় বর্ণমালা লেখা হত, তাকে সেমিটিক লিপি বলে। তারপর আসে গ্রিক লিপি ও গ্রিক বর্ণমালা। আরও পরে একে-একে এল সিপ্রিয়টিক, রুনিক, ওগ্যাম, স্নাভোনিক, রোমান প্রভৃতি লিপি।
এখন প্রশ্ন হল, কোথায় রাখব ভারতের হরপ্পা লিপিকে, ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠীকে? অর্থাৎ প্রাচীনতার দিক থেকে ওই ভারতীয় লিপিগুলির স্থান কী? হরপ্পার লিপি নিঃসন্দেহে অতি প্রাচীন। তার বয়স অন্তত চার কি সাড়ে চার হাজার বছর। কোনও-কোনও বিদেশি বিশেষজ্ঞের মতে হরপ্পা বা সিন্ধু লিপি বিদেশি কোনো লিপির প্রভাবপ্রসূত। সাদৃশ্যের জন্যই এই অনুমান। অন্য দিকে খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী সম্পূর্ণ ভারতীয়, যদিও এ-দু’টির উপর হরপ্পা লিপির প্রভাব ছিল। আর এই কথাটিও স্বীকৃত যে, প্রধানত ব্রাহ্মী থেকে বাংলা লিপি বিবর্তিত।
বাংলা লিপির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের কাহিনিটি বিশ্লেষণ করেছেন গবেষক সুবীর মণ্ডল। তিনি বাংলা লিপির উৎস হিসাবে ব্রাহ্মীর দাবি পর্যালোচনা করেছেন। মূল ব্রাহ্মী থেকেই নয়, ব্রাহ্মী বিবর্তিত রূপ থেকেই যে বাংলা লিপির উদ্ভব, তা-ও দেখিয়েছেন তিনি। বিশেষত, গুপ্ত-পরবর্তী ‘কুটিল লিপি’ থেকেই বাংলা লিপি এসেছে বলা যায়। এই গ্রন্থের ‘মুদ্রণ পূর্ববর্তী বাংলালিপি [য.] বিবর্তন’ নিবন্ধে বিষয়টি স্পষ্ট ধরা পড়েছে। বাংলা লিপিকে বলা যায় অক্ষরলিপি (syllabic script) যা নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মীর উন্নততর সংস্করণ। বাংলা লিপিতে শব্দলিপি (logo graph) ও বর্ণ লিপির (alphabetic script) সংমিশ্রণ ঘটেছে। ব্রাহ্মীর আর-এক বিবর্তিত রূপ নাগরী লিপির বিকাশ এক হাজার খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঘটলেও প্রত্নবাংলা বা গৌড়ী লিপির বিকাশ দশম থেকে ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতকের ঘটনা। এর মধ্যে দু’টি বিশেষ দিকচিহ্ন হল রাজা মহীপালের (৯৮০-১০৩৬) ‘বাণগড়’ লেখতে ব্যবহৃত লিপি এবং সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের (১০৯৮-১১৬০) ‘দেওপাড়া’ লেখতে ব্যবহৃত লিপি, যেখানে অক্ষর চিত্রগুলি অনেকটাই এখনকার আদল পেয়েছে। এই বিষয়টি প্রথম বিশ্বাসযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘দ্য ওরিজিন অফ দ্য বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট’ (১৯১৯) গ্রন্থে।
আলোচ্য গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় (মুদ্রণ পূর্ববর্তী বাংলা লিপি বিবর্তন) লেখক বাংলা লিপির এই প্রাক্-ইতিহাসের একটা নির্ভরযোগ্য বিবরণ দিয়েছেন। তবে এখানে এবং চতুর্থ অধ্যায়ে অধ্যায়ের শিরোনাম লেখায় স্পষ্টতই ভুল হয়েছে। ‘বাংলালিপি বিবর্তন’ হয় না, লেখা উচিত ‘বাংলা লিপির বিবর্তন’। দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক আরও একটি ভুল করে ফেলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘ড. সুকুমার সেন মনে করেন চর্যাপদগুলি রচিত হয় আনুমানিক চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে (পূ. ৩৬)। না, সুকুমার সেন তা বলেননি। দেখা যাক, কী বলেছেন তিনি–
টীকার রচনাকাল চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী বলিয়া বোধ হয়। মূল গীতগুলি টীকা রচনার বহু পূর্বে লেখা হইয়াছিল (‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, প্রথম খণ্ড, ১৯৯১, পূ. ৫৫)।
বাংলা পুথির লিপিচরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে ‘বাংলা পুঁথির লিপি বৈশিষ্ট্য’ অধ্যায়ে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মুদ্রণের সূত্রপাত। তার আগে প্রায় আটশো বছর যা-কিছু লেখালিখি, সবই আছে পাণ্ডুলিপিতে অর্থাৎ পুথিতে। কিন্তু প্রাচীন পুথি মাত্র কয়েকটিই পাওয়া গেছে। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য বলেছেন,
‘বাংলা পাণ্ডুলিপির অভাব নাই। বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংগৃহীত পুথির সংখ্যা বহু সহস্র’ (‘বাগর্থ’, ১৯৭৭, পৃ. ৫১)।
কিন্তু চর্যাগীতি বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো দু’-চারটি পুথি মৌলিকতা নিঃসংশয়িত হলেও পরবর্তী অধিকাংশ পুথি অনুলিখিত বা পুনর্লিখিত। শুধু তা-ই নয়। মুদ্রণের সময় সম্পাদকেরা প্রায়ই পুথির সংস্কার করে নিতেন। এই সংস্কারের ফলে অনেকসময় পুথি মূল থেকে সরে যেত। লেখক এই অধ্যায়ে সেকালের লিপি বিচার করেছেন দুই দিক থেকে এক, লিপিকরদের বানানরীতি এবং দুই, অক্ষরের ছাঁদ। প্রাচীন পুঁথির বানান নিয়ে অনেক আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে। সে-আলোচনার অন্যতম পথিকৃৎ বিজনবিহারী ভট্টাচার্য। সুবীর মণ্ডল অক্ষরের ছাঁদের যে-আলোচনা করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু যেটা প্রায়ই মনে রাখা হয় না, তা এই যে, লিপি (script) আর লিখনরীতি (writing system) এক নয়। লিপি হল হরফ চরিত্র। হরফচিত্রও বলা যায়। রোমান বা রোমক লিপি, তামিল লিপি, নাগরী লিপি– এগুলি হল কোন ভাষা, কোন লিপিতে লেখা হয় তার কথা। অন্য দিকে, একটা শব্দ কীভাবে কোন বানানে লেখা হবে বা হচ্ছে, তা হল অর্থোগ্রাফির কথা। করিয়াছে বা করিঞাছে, পৃথিবী ও প্রিতিবি– এসব লিপির আলোচনায় অপরিহার্য নয়। ৪২ নম্বর চর্যার ‘তিম মরণ’ বা ‘তিমমরণ’ ইত্যাদি কে কীভাবে পাঠ ধরেছেন (পৃ. ৪৭), সেটা পুথির আলোচনায় নিশ্চয়ই আসতে পারে। কিন্তু লিপির প্রসঙ্গে আসবে কেন? বর্ণমালাকে লিপির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয় অনেকক্ষেত্রে। যেমন ১৩৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা লিপির সংস্কারসাধনে ব্রতী হন’। বিদ্যাসাগর বাংলা ‘লিপি’র সংস্কার করেননি। সংস্কার করেছেন বর্ণমালার। এই দু’টির তফাত অবশ্যমান্য। শিথিল প্রয়োগে অবশ্য ‘লিপি’ আর ‘বর্ণমালারূপ’ কখনও-কখনও মিলে যায়। একটা টেকনিক্যাল বইয়ে এই দু’টিকে মিলিয়ে দেওয়া সংগত নয়। এই বইটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘বাংলা লিপি ও বর্ণমালার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’। লেখক প্রায়ই বর্ণ অর্থে লিপি শব্দটি ব্যবহার করেছেন— ‘সমস্যা হল ‘অ্যা’ ধ্বনির ব্যাপক ও অবধারিত প্রয়োগ থাকলেও তার জন্য কোনও নির্দিষ্ট লিপি নেই’ (পৃ.১৩৩)। মুদ্রণ আসবার পরে বাংলা লিখনরীতিতে কী পরিবর্তন হয়েছে, সে সম্বন্ধে চতুর্থ অধ্যায়টি সুলিখিত।
এই বইটি আকারে ছোট হলেও লেখায় প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা বোঝাই যায়। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই, বানান ভুল আর প্রতিবর্ণীকরণে ভুল রয়েছে পাতায়-পাতায়। কিঞ্চিত (পৃ. ১৪৩), উৎকর্ষতা (১৩৭), সেমেটিক (১৯), হিয়েরোগ্লিফিক (১৭), পরমার্থিক (৪২), যুক্তক্ষর (৫১), সমাচার দর্পন (৭৮, ৭৯, ৮১)। এছাড়া জার্মান, ফরাসি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ও নাম লেখায় বিস্তর বিপত্তি দেখা যাচ্ছে। ৯৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন— ‘ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয়, জার্মানি, প্রভৃতি ইউরোপীয় ভাষায়..’। জার্মানি কি একটা ভাষার নাম? উদ্ধৃতিতেও লেখককে অমনোযোগী দেখতে পাই। সুনীতিকুমারের ভাষা-প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণের একটি বাক্য তুলেছেন এইভাবে— ‘হসন্ত যুক্ত ব্যঞ্জন ধ্বনিকে হল্ বলে’। এমনটা লেখা সুনীতিবাবুর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। আসলে সুনীতিবাবু লিখেছেন, ‘হসন্ত-যুক্ত ব্যঞ্জন-ধ্বনিকে হল্ বলে’।
গ্রন্থ সমালোচনা / বাংলা লিপির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ / সুবীর মণ্ডল, দে'জ পাবলিশিং / বইয়ের দেশ- অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১১