ঔপনিবেশিক পর্বের অবসানে ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ পর্বে বিশেষত সত্তর-আশির দশকে প্রান্তিকায়িত বর্গের প্রচ্ছন্ন কণ্ঠ মুখর হতে শুরু করলো সেই সময়ের উপন্যাস-ছোটগল্পে। সমালোচকের মন্তব্যের সঙ্গে বিষয়টি মিলিয়ে নেওয়া যায়,
|
‘আড়কাঠি’ |
“ উত্তর-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রধান প্রবণতা হলো প্রান্তিকের বিদ্রোহ, যার দরুণ অভিজ্ঞতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং তা বহুত্ত্ববিশিষ্ট বা প্লুরালিস্টিক। এতদিন যেসব কণ্ঠস্বর নিরুদ্ধ ছিল, প্রান্তিকায়িত সেইসব বর্গের উপস্থিতি স্বীকৃত হচ্ছে উত্তর-ঔপনিবেশিক বয়ানে।”[দ্রষ্টব্য- রাহুল দাশগুপ্তের প্রবন্ধ ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক আখ্যান’, উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বাংলা সাহিত্য (সংকলক- চিরঞ্জীব শূর), মে ২০১৭, আলোচনাচক্র। পৃ: ৬৫]
ঔপনিবেশিক আখ্যানে ক্ষমতার যে কেন্দ্রটিকে গড়ে তোলা হয়েছিলো, সেই কেন্দ্রটিকেই ঔপনিবেশিকোত্তর আখ্যানে বার বার আক্রমণ করা হয়েছে। আর এ সম্ভব হয়েছে বিকল্প এক দৃষ্টিকোণে, যা দেশজ অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এইভাবে ক্রমে বাংলা সাহিত্যে মূল প্রবণতা হিসেবে স্পষ্ট হলো ‘সাব-অলটার্ন ডিসকোর্স’ বা ‘নিম্নবর্গের বয়ান’। একদল সাহিত্যিকদের প্রতিবেদনে মূলসুর হিসাবে ধ্বনিত হলো দেশ, মানুষ ও ঐতিহ্যাগত জাতীয় সংস্কৃতি। গ্রামবাংলা ছাড়িয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ আদিবাসীদের জীবনকাহিনীও এঁদের লেখায় স্বমহিমায় স্থান পেল। এই গোষ্ঠীতে রয়েছেন ভগীরথ মিশ্র, সাধন চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন, অমর মিত্র, নলিনী বেরা, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, সৈকত রক্ষিত প্রমুখ আখ্যানকাররা। অন্তেবাসী জনজীবনের অস্তিত্বসংকট, জীবন-জীবিকার বৈচিত্র্য তথা সংকট, ক্রম-বর্ধিষ্ণু সমাজ পরিসরে প্রান্তিক মানুষের দিশেহারা অবস্থা এই পর্বের সাহিত্যিকদের রচনার একটি বৈশিষ্ট্যরূপে প্রকাশ পেল।
১৯৮০-র পরবর্তী এই প্রবণতা থেকে উঠে আসছেন একঝাঁক তরুণ কথাসাহিত্যিক যাদের মধ্যে ভগীরথ মিশ্র, নলিনী বেরা, অভিজিৎ সেন, অনিল ঘড়াই, সাধন চট্টোপাধ্যায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, অমর মিত্র, অনিতা অগ্নিহোত্রী প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ….. এদের উপন্যাসে আজকের গ্রাম্যজীবন তাদের জীবনবৃত্তি, জীবিকার সংকট তথা বৈচিত্র্য ; কাকমারা, মাছমারা, লোধা-শবর্ মাছ-কাছিমের ব্যবসা, নুনমারা, অন্ত্যজ জংলী সম্প্রদায়ের মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রার বৈচিত্র্য ; সংস্কার-ভাষা প্রভৃতি এক নতুন মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে পাঠকের সামনে। এদের লেখার মধ্যে দিয়ে উপন্যাস শৈলীর পুরনো আধার বা আধেয় পরিত্যক্ত হয়ে গড়ে উঠলো নিজস্ব এক দেশজ-সংস্কৃতির রূপনির্মাণ। প্রান্তীয় অন্তেবাসী সাধারণ মানুষ সেখানে মুখ্য নিয়ন্তা হয়ে বাংলা উপন্যাসকে এক মুহূর্তে আন্তর্জাতিকতার স্তরে স্বতন্ত্র জায়গা করে দিল।
বাঁকুড়ার অখ্যাত জঙ্গলঘেরা গ্রাম গজাশিমূলের গোটা তিরিশেক বসু-শবর পরিবারের জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনি এই ‘আড়কাঠি’ উপন্যাসের মূল আধেয়। বাঁকুড়া আর মেদিনীপুর জেলার সীমান্তে অবস্থিত আধুনিক জনজীবন-বিচ্ছিন্ন দুর্গম এক গ্রাম গজাশিমূল এই প্রতিবেদনের আখ্যান-পট। গজাশিমূল ভারি দুর্গম, সেখানে যাওয়াও কষ্টকর। ‘বাঘমুড়ি, মইষমুড়া পেরিয়ে সে পথ ক্রমশ হারিয়ে গ্যাছে বাঁকুড়া আর মেদিনীপুরের সীমান্ত এলাকায়। সেখানে শুধু জঙ্গল, ডুংরী, পাহাড়। সে পথ ধরে ঘণ্টা দু-তিন নাগাড়ে হাঁটলে জঙ্গলের মধ্যেই গজাশিমূল গাঁ।’ মূলস্রোত-বিচ্ছিন্ন এই গাঁয়ের লোকেরাও কম বিচিত্র নয়।এরা পাহাড়বাসী, তাই কৃষিকাজে অপটু। জঙ্গলে জঙ্গলে শিকার করা, মৌচাক ভাঙা, ফলমূল-কন্দ সংগ্রহ করা, শাল কাঠের ‘ঈশ’ বানানো কিংবা মালিকের হুকুমে চোরাই কাঠ কাটা এদের নিত্যদিনের কাজ। একেই এরা জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ এদের নেই। সহজ-সরল অভ্যস্ত জীবনে উপদ্রপের শেষ নেই, তার মধ্যে একটি হলো রঙলাল।
রঙলাল গজাশিমুলের নিস্তরঙ্গ জীবনে হটাৎ আবির্ভূত হয়ে সবকিছু আগছালো করে দেয়। সে একটা আড়কাঠি অর্থাৎ দাস-ব্যবসায়ী। ‘ইস্ট-ওয়েস্ট ফোক ফাউন্ডেশনে’র ইস্টার্ন জোনের ডিরেক্টর ক্যাথি বার্ডের ভাষায় ‘স্লেভ হান্টার’। ঔপনিবেশিক সময়ে কিংবা উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে আসামের চা বাগানগুলির ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ঔপনিবেশিক সময় থেকেই চা বাগানগুলিতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন মেটাতে এইসব সহজ সরল আদিবাসীদের চালান করা হতো সেখানে ; কখনো জোরপূর্বক অপহরণ করে কখনো রঙলালের মতো শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে। রঙলালের মতো আড়কাঠিদের ফাঁদে দশরথ ভক্তা, বদন কোটালদের পড়তেই হয়। শিকার মেরে, চোরাই কাঠ কেটে জীবন তো চলবার নয়। তাই হাত পাততে হয় রঙলালের কাছে। এইভাবে রঙলালের লাল রঙের বাঁধানো খাতায় নাম উঠে যায় তামাম উঠতি মেয়ে-মরদের। রঙী, সরস্বতীদের মতো মেয়েদের জন্য আবার আলাদা ব্যবস্থা। তারা চালান হয়ে যায় চা-বাগান সংলগ্ন কোনো বেশ্যাপল্লীতে।
এই দাসত্ব থেকে, জুলুমের অচ্ছেদ্য জাল কেটে বেড়িয়ে আসার সামর্থ্য গজাশিমূল কেনো আরও শত শত প্রত্যন্ত গ্রামেরও নেই। কিন্তু গজাশিমূল পেরেছিল এই জাল কেটে বেড়িয়ে আসতে, তারা স্বনির্ভর হতে চেয়েছিল। কলেজের অধ্যাপক রাজীব চৌধুরী গজাশিমূলের মানুষের কাছে দেবদূতের মতো এসেছিলেন। গ্রামে প্রতিষ্ঠা হলো ‘গজাশিমূল সংস্কৃতি সংঘ’। রাজীবের যুগপৎ অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনায় গজাশিমূলবাসীদের লৌকিক নৃত্যকলা শহরবাসী, কল্পচারী মানুষদের কাছে পৌঁছে গেল।
প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের এই সাফল্য অনেকটাই দ্রুতগতিতে ঘটে যায়। রঙলালের হাত থেকে তাদের বাঁচাতে মাস্টার তো আছেই। এইভাবে কাহিনীর গতি দ্রুততর হয়। কিন্তু মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগে না। তাদের কৌলিক নৃত্য ‘জলকেলি নাচ’, শুধুমাত্র রমণীদের অংশগ্রহণে এই নৃত্য স্বর্গীয় মান্যতা পায় ; সেই নাচকে তারা সর্বসমক্ষে প্রত্যক্ষ করে। গোপনে সযত্নে রেখে দেওয়া পবিত্র বস্তুকে সর্বসমক্ষে আনার মূল্য দিতে হয় সমগ্র গজাশিমূলের মানুষকে। এইভাবে ঔপন্যাসিক কাহিনির প্রতিবেদনে গড়ে তোলেন এক ট্র্যাজিক আখ্যান।
আলোচ্য উপন্যাসটির পুঙ্খানুপুঙ্খ পঠনে মূল কাহিনির দুটি ধারা স্পষ্ট হয়, প্রথমতঃ প্রত্যন্ত গজাশিমূলবাসী মানুষের সহজ-সরল জীবন ধারা ; দ্বিতীয়তঃ শহুরে আগ্রাসন। উত্তর-উপনিবেশিক সময়ে এই শহুরে আগ্রাসনের অবশ্যম্ভাবী ফল জীবিকা সংকট ও বিবর্তন। পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে শিকার মারা, কাঠের ঈশ তৈরি, চোরাই কাঠ কাটা সর্বোপরি রঙলালের কাছ থেকে দাদন নেওয়া বন্ধ হয়। চাষে এরা দক্ষ নয়, সেজন্যে নিজেদের সংস্কৃতিকেই বেছে নেয় জীবিকার অনুষঙ্গ হিসেবে। সুচাঁদের স্বপ্নের গজাশিমূল স্বপ্নেই থাকে, জীবিকার তাড়নায় সামান্য একটু সুখের খোঁজে তাদের মূলচ্ছেদ অনেক পূর্বেই ঘটে গেছে। তাই শেষপর্যন্ত ছদ্ম-আধুনিকতার আগ্রাসনে নিঃস্ব গজাশিমূল ফিরে যায় স্বস্থানে ; সেই কন্দর্প সরকার, অঘোর রায়ের কবলে, রঙলালের বাঁধানো লাল খাতায়।
বসু-শবরদের শিকারমারি থেকে পালাগায়কে উত্তরণ আবার পালাগায়ক থেকে শিকারমারি-মজুরে প্রত্যাবর্তন—এই যে জীবিকার সংকট তা ভারতের সমস্ত আদিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আড়কাঠিদের দালালিতে আসাম মুলুকে বেশ্যা হয়ে যেত কৌশল্যাদের মতো বসু-শবরদের মেয়েরা। পক্ষান্তরে রঙীও মঞ্চভোগ্যা হয়ে যায় শহুরে বাবুদের কাছে, সেও বেশ্যার নামান্তর। বস্তুত শহুরে আগ্রাসনে আদিবাসী জনজাতি ঘুরেফিরে সেই ভোগ্যবস্তুতে পরিণত হয় ; কখনো আদিবাসী মেয়ে কখনো আদিবাসী সংস্কৃতি।
আলোচ্য ‘আড়কাঠি’ উপন্যাসের মূল অন্বিষ্ট হলো আদিবাসী ও তাদের সংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতিচর্চা আমাদের দেশে পূর্বে শুরু হলেও উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে ‘সাব-অলটার্ন’ চর্চার সুবাদে কিছু শৌখিন লোকসংস্কৃতিবিদের বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা গেল। তাদের হাতেই সংস্কৃতির পণ্যায়নের সূচনা।
ক্রমশ সংস্কৃতি বাঁচানোর নামে , রাজীবের মতো সংস্কৃতিপ্রেমীদের অর্থ, উৎসাহ দিয়ে লোকসংস্কৃতিকে বাজারি দ্রব্যে পরিণত করেছে। গজাশিমূলের মানুষের প্রতি রাজীবের প্রাথমিক উৎকণ্ঠা স্বাভাবিক। এমনকি তাদের স্বনির্ভর করানোর প্রচেষ্টায় রাজীবের কোনো দূরভিসন্ধি ছিল না। কিন্তু অবস্থান্তরে সে বাধ্য হয়েই লোভের ফাঁদে পা দেয়, তার অজান্তে সূচনা হয় সংস্কৃতির পণ্যায়ন। সরল আদিবাসীদের স্বনির্ভর করতে তাদের একমাত্র সম্বল কৌম-সংস্কৃতি উন্মুক্ত বাজারে বিক্রীত হয় আর এই ধারাকে যারা চিরকাল আগলে রেখেছে তারা পরিণত হয় বাইজিতে। এই পণ্যায়নে রাজীব একা দায়ী নয়, একইসঙ্গে দায়ী রঙলাল, ক্যাথিবার্ড, সংস্কৃতিমন্ত্রক এবং সর্বোপরি সংস্কৃতিকে যারা উপভোগ্য বস্তুজ্ঞান করে সেইসব আপামর মেকি সংস্কৃতিমন্য মানুষ।
এই উপন্যাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব হলো এর গঠনশৈলী। সংখ্যা নামাঙ্কিত পরিচ্ছেদ নয়, অসংখ্য শিরোনামযুক্ত পরিচ্ছেদের গাঁথুনিতে ভগীরথ মিশ্র গড়ে তুলেছেন যে ইমারত তার ভীত-ভূমি এই দেশের অন্তেবাসী কতিপয় নিরক্ষর মানুষজন। বস্তুত অসংখ্য পরিচ্ছেদের সমবায়ে লেখক দেশজ সংস্কৃতি ও তার ধারক-বাহক সম্বলিত বহুস্বরিতাকে ধরতে চেয়েছেন উপন্যাসের প্রতিবেদনে— ‘আড়কাঠি’ তাই শুধু দালালদের কাহিনি নয়, দালালদের হাতে নিষ্পেষিত হওয়া সেইসব অগণিত বসু-শবর-লোধা-সাঁওতাল প্রভৃতি আদি জনজাতিদের জীবনাখ্যান।
. |
. |
বই |
আড়কাঠি |
লেখক |
ভগীরথ মিশ্র |
প্রকাশক |
দে’জ, কলকাতা |
প্রকাশ |
১৯৯৩ |