বাংলা ছোটোগল্পের জন্ম হয়েছে উনিশ শতকের শেষের দিকের। বলতে গেলে বাংলা ছোটোগল্পের বয়স বেশি নয়। রবীন্দ্রনাথের হাতেই সর্বপ্রথম সর্বাঙ্গ সুন্দর ছোটোগল্প নির্মিত হয়েছে। যাইহোক বিষয়বস্তুর নিরিখে বাংলা ছোটোগল্প বহুমুখী। আজকের বিষয় পতিতা সমস্যা। পতিতা, বেশ্যা বাংলা ছোটোগল্পে কিভাবে এসেছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো।

 


পতিতা সমস্যা ও বাংলা ছোটগল্প

বাংলা ছোটগল্পে পতিতা জীবনকেন্দ্রিক ছোটগল্পের সংখ্যা সুপ্রচুর। স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাল আমলের প্রায় প্রত্যেক লেখকই একটা-না-একটা পতিতা-জীবনকেন্দ্রিক গল্প রচনা করেছেন। এই সুবিপুল গল্পভাণ্ডারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্পের তালিকা এখানে উল্লেখিত হল-

[ads id=”ads1″]

  • ১. বিচারক : রবীন্দ্রনাথ
  • ২. কাশীবাসিনী : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
  • ৩. বিপদ : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • ৪. মেলা : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
  • ৫. আজকাল পরশুর গল্প : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
  • ৬. ইতি : অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
  • ৭. গোষ্পদ, মন্ত্রশেষ : মণীশ ঘটক
  • ৮. চোর চোর : বুদ্ধদেব বসু
  • ৯. সংসার সীমান্তে, মহানগর : প্রেমেন্দ্র মিত্র
  • ১০. বারবধূ : সুবোধ ঘোষ

পতিতা জীবন কেন্দ্রিক এসব গল্পে নানা মাত্রা, নানা বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে। তা সংক্ষেপে আলোচনা করা গেল –

  • ক. পতিতা জীবনকেন্দ্রিক গল্পগুলিতে প্রায়শ দেখা যায়, অর্থনৈতিক চাপে ক্লিষ্ট হতভাগ্য নারী নিতান্ত নিরুপায় হয়ে দেহ ব্যবসাতে নেমেছে।
  • খ. পতিতা জীবনযাপন ও কারিণীদের বেশিরভাগেরই মনে মাতৃত্ব ও স্নেহবাৎসল্যের অনবদ্য রসস্ফুরণ লক্ষিত হয়।
  • গ. বেশকিছু ক্ষেত্রে পতিতা নারীদের প্রতিবাদীর ভূমিকায় দেখা গেছে। সামাজিক নীতি চেতনার ফাঁকির ঘরে তাদের প্রচণ্ড আঘাত পড়েছে।
  • ঘ. পতিতা নারীদের মনে, প্রায়শ ক্ষেত্রেই, সুখী-গৃহ নীড় আকাঙ্ক্ষার একটা স্থায়ী বাসনা থাকে।
আরো পড়ুন :  ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রবীন্দ্রনাথের বিজয়া রবীন্দ্র-কবিতার মাঝে

এবার গল্পে-গল্পে পতিতা সমস্যার যে সুনিপুণ চিত্র বিভিন্ন লেখক তুলে ধরেছেন তার কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করা হল–

বিচারক – 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিচারক’ গল্পে পতিতা জীবন থেকে মুক্তিকামী নারী ক্ষীরোদা ওরফে হেমশশীর করুণ কাহিনি বর্ণিত। হেমশশী তার সামাজিক জীবন থেকে পতিত হয়ে নাগর ধরার খেলায় ওস্তাদ খেলুড়ে। বিনোদচন্দ্র ওরফে মোহিতমোহন তাকে কুলটা করেছিল। আসলে পতিতা ক্ষীরোদা চাইছিল একটি স্থায়ী গৃহকোণ। কিন্তু একদিন তার শেষতম নাগরটিও ফাকি দিয়ে উড়ে গেল। তখন কপর্দকশূন্য অবস্থায় তার সামনে একটাই পথ খোলা ছিল—আবার সন্ধ্যাতে খদ্দের ধরার মহড়া করা। কিন্তু সুখী গৃহকোণের অভিলাষী ক্ষীরোদা তা মানতে চাইল না। সে চাইছিল মুক্তি। সেই মুক্তির সন্ধানে সে ঝাপ দিল কূপে– পুকুরে। পুত্র সমেত। ফলে একটি মৃত্যু সংঘটিত হল। তার শিশুপুত্র মারা গেল। এই মৃত্যুই গল্পে অন্যমাত্রা আনল। বিচারক মোহিতমোহন ক্ষীরোদার ফাঁসি ঘোষণা করল। তারপর কৌতূহল মেটাতে ক্ষীরোদার কাছে গিয়ে তার হাতের আংটি দেখে সে জানল ক্ষীরোদাকে সে-ই এ পাপপথে এনেছিল। এই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধী মোহিতমোহন চিহ্নিত হয়ে পড়ল। আর ক্ষীরোদার সব পাপ যেন ধুয়ে মুছে গেল।

 

কাশিবাসিনী –

‘কাশিবাসিনী’ গল্প পতিতা নারীর স্নেহ বাৎসল্যের অনবদ্য নির্মাণ। গল্পকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় নাটকীয় উৎকণ্ঠা ও কৌতুহল বজায় রেখে এ-চিত্র এঁকেছেন। স্বামী মারা যাবার পর মালতীর মা একবার পাপ পথে নেমে সারাজীবন তার প্রায়শ্চিত্ত করেছে। ওদিকে মালতী জানে সে মাতা-পিতৃহীন। সে এখন স্বামী সংসার নিয়ে সুখী। এদিকে কন্যার দানাপুরে থাকার সংবাদ পেয়ে কাশিবাসিনীর পতিতা হৃদয় কন্যা-বাৎসল্যে সেখানে ছুটে গেছে। কিন্তু এই মাতৃস্নেহ সমাজের সদর দরজায় স্থান পায়নি। পতিতা রমণী শুনে সন্তান মালতীও প্রথমে ভ্র কুঁচকেছে। আবার জামাতা জানতে পারলে মেয়ের ঘরের সুখ নষ্ট হবে এই ভেবে এক আকুল মাতৃহৃদয় নীরবে চলে গেছে।

আরো পড়ুন :  রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা ছোটগল্প, নতুনত্ব বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন

বিপদ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিপদ’ গল্পে পতিতা নারীর, গণিকা নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শিত। মন্বন্তরের প্রকোপ যে এক সময়কার বঙ্গললনাদের পাপ পথে চালিত করেছিল তার অনবদ্য নির্মাণ ‘বিপদ’ গল্পটি। মন্বন্তরের প্রকোপে ভিক্ষা না পেয়ে হাজু গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে। যদিও মানবতাবাদী লেখক তাকে ঘৃণিত করে আঁকেননি। তার বদলে গল্পে চিত্রিত হয়েছে সহানুভূতি। সহানুভূতির জারক-রসে হাজুর পদস্থলন এখানে সমর্থিত।

মেলা – 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মেলা’ গল্পে পতিতা-জীবনের স্নেহ বাৎসল্যের নির্মাণটি অনবদ্য হয়েছে। এখানে এক পতিতা রমণীর প্রতিবাদ-চেতনার মাধ্যমে এই বাৎসল্যের রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। পতিতা কমলি মেলাতে এসেছে অর্থোপার্জনের জন্য। এসেছে তাদের মালকিন—‘মাসি’। এসেছে দলবল সমেত। ছোটো ছোটো দুই ভাইবোন অমর ও মণি মেলা দেখতে এসে পথ হারিয়ে ঐ বেশ্যা-পটিতে ঢোকে। তাদের দেখে পতিতা কমলির মনে মাতৃত্বের উদ্বোধন ঘটে। আর ‘মাসী’র নজর পড়ে মণির উপর। মাসীর আগ্রাসী থাবার হাত থেকে মণিকে বাচাতে কমলি তাদের নিয়ে পালিয়ে যায়। কোমল শিশুকে পতিতা জীবনে না আনার পক্ষে এখানে প্রতিবাদ ধ্বনিত।

আজকাল পরশুর গল্প – 

এখানে পতিতা জীবনকে কেন্দ্র করে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ চেতনা ও সংগ্রামী জীবনের রূপটি নব ভাব-ভাবনার আলোকে প্রকাশিত।

আরো পড়ুন :  অন্ত্যজ জীবন ভাবনা ও বাংলা উপন্যাস


[ads id=”ads2″]

সংসার সীমান্তে – 

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সংসার সীমান্তে পতিতা-জীবন নিয়ে রচিত একটি রসসার্থক ছোট গল্প। একদিন রাতে তাড়া খেয়ে চোর অঘোর পতিতা রজনীর ঘরে ঢোকে। নিরাপদ আশ্রয় পেতে সে রজনীকে একটাকা দেয়। কিন্তু সেদিন ভোরেই সে সেই টাকা চুরি করে পালিয়ে যায়। তিন-চারদিন পর আবার এলে রজনী হৈ চৈ বাধায়। মারধর করে। অঘোর আধমরা হয়ে পড়ে। কিন্তু পুলিশের ভয়ে সেই আধমরা অঘোরের সেবার ভার রজনীকেই নিতে হয় এবং এইভাবে ক্রমে দুটি অন্ধকারের বাসিন্দা একে অপরের কাছাকাছি এসে যায়। তাদের মনে ঘর বাঁধার সাধ জাগে। তাই বাড়িওয়ালির টাকা শোধ দেবার জন্য অঘোর শেষবাবের মতো চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে তার জেল হয়। ফলে ঘর আর বাঁধা হয় না তাদের। রজনীকে আবার খদ্দেরের আশায় বসতে হয়। জীবনের ঘরে প্রবেশের আগে তারা সংসারে নয়—ছিল সংসারের সীমান্তে। জীবনের শেষেও সেখানে তারা দাঁড়িয়ে থাকে। সাধ থাকলেও, সমাজ তাদের সংসারে প্রবেশের অধিকার দেয় না।


—————————–

সাহায্য – সোহারাব হোসেন

—————————-


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *