থার্ড থিয়েটারের অভিনয় পদ্ধতি



থার্ড থিয়েটারের অভিনয় পদ্ধতি


চুম্বক :
  • বাঁধামঞ্চ থেকে সরে আসা।
  • অভিনয় পদ্ধতিতে নতুনত্ব।

প্রসেনিয়ামের বাঁধামঞ্চ থেকে সরে এসে বাদল সরকার পরপর পনেরোটি নাটক অঙ্গনমঞ্চে অভিনয় করলেন তাঁর ‘শতাব্দী’ নাট্যদলকে নিয়ে। কলকাতার ক্যাথিড্রাল রোডে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এর তেতলার হলঘরে এবং কলেজ স্ট্রিটের থিওজফিক্যাল সোসাইটির দোতলার ছোট হলঘরে অঙ্গনমঞ্চের অভিনয়ের সময়ে সেখানে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের কোনো উপকরণই রইল না৷


অভিনয় পদ্ধতি

১] ঘরের চারপ্রান্তেই দুই-তিন সারিতে চেয়ার পাতা। একদিকে একটু উঁচু একটা প্লাটফরম, তারও গা ঘেঁষে তিন-চার সারি চেয়ার। মাঝখানের পুরো মেঝে খালি — ওইখানেই অভিনয় হয়।

২] প্লাটফর্মের আড়াল থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় ক্ষেত্রে আসা-যাওয়া করে।

৩] তাদের পোশাক-আশাক সাধারণ— কখনোই কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের মতো নয়। তারা তাদের নিজেদের রূপসজ্জাতেই অবতীর্ণ হয়।

৪] কখনও কোনো চরিত্রকে আলাদা করে বোঝাতে কোনো বিশেষ উপকরণ তার গলায় চড়িয়ে দেওয়া হয়। যেমন, ‘রূপকথার কেলেঙ্কারী’-তে অভিনেতাদের পিঠে তাদের পরিচয় লিখে দেওয়া হয় — কে রাজপুত্র, কে কোটালপুত্র, কেই-বা দূত বা জহ্লাদ।

৫] কোনো ব্যাক্তিবিশেষ কোনো ব্যাক্তিচরিত্রের হয়ে নামে না, কোনো ব্যাক্তিচরিত্রকে নিয়েও, বা কোনো চরিত্র বিশেষকে নিয়েও কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্দিষ্ট থাকে না৷ প্রত্যেক নাটকেই থাকে একটা ‘থিম’ বা ফুটিয়ে তোলা হয় সমাজের নানান চরিত্রের নানান রূপের মধ্য দিয়ে।

৬] অঙ্গনমঞ্চে মঞ্চোপকরণ থাকছে না বলে অভিনয়ের সময় কখনও কাপড়, কখনও ধুতি শাড়ি, কখনও একগাছি দড়ি, বা কখনও একটি ছোটো লাঠি ব্যবহার করা হয়। জাদুকরের হাতের দণ্ডের মতো এগুলিকে ব্যবহার করে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে কিংবা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যাওয়া হয়৷

প্রসঙ্গক্রমে ‘পদ্মানদীর মাঝি‘ প্রযোজনায় একটি সাদা কাপড় ব্যবহার করা করেন বাদল সরকার। এই কাপড়টি চরিত্রদের হাতে ধরা থাকে ৷ সেটা দিয়েই তৈরি হয় কখনও পদ্মানদীর ঢেউ, নৌকার পাল, জেলেদের ঘরদোর, কখনও বা পোটলা কিংবা বোঁচকা। প্রত্যেকটি দৃশ্যেই এই কাপড়টিকে এমনভাবে ব্যবহার করা হত, যাতে কখনই বোঝা না যায় এই কাপড়টা নাটক থেকে আলাদা। এইভাবে নাটকের সঙ্গে, চরিত্রদের সঙ্গে এবং বলতে কী, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গেও কাপড়টা একাকার হয়ে যায়।

৭] আবহসংগীত নির্মাণ এবং যন্ত্রানুষঙ্গের অভাব পূরণ করা হয় অন্যভাবে। নাটকের চরিত্ররাই একক, কখনও সমবেতভাবে মুখ দিয়ে আওয়াজ তুলে শব্দ তৈরি করে—  কখনো জলের শব্দ, বাঁধভাঙার শব্দ, পাখির আওয়াজ, বন্দুকের গুড়ুম গুড়ুম, কারখানার ভোঁ, কোলাহল মুখরিত বাজার।

৮] দৃশ্য নির্মাণ কিংবা মঞ্চোপকরণ সংস্থানে চরিত্রেরাই শারীরিক প্রক্রিয়ায় ইঙ্গিতগুলি গড়ে তোলে ৷ কখনো দুই চরিত্র দাঁড়িয়ে হাত-পা-শরীর দিয়ে দরজা বানায়, স্যুইং ডোর তৈরি করে, এমনকি চেয়ার-টেবিলও গড়ে তোলে ৷ শরীর দিয়ে তৈরি হয় টিউবওয়েল ৷ সেই টিউবওয়েলের হাতল ধরে আরেকজন পাম্প করতে থাকে।

থার্ড থিয়েটার নির্মাণ কৌশলে মঞ্চসজ্জা, সাজসজ্জা কিংবা দৃশ্যসজ্জার বাহুল্য ও অর্থব্যয়কে সহজ নির্মিতিতে নিয়ে এসেছে। কারও কারও কাছে এগুলিকে ‘স্টান্ট’ বা ‘চমক’ বলেও মনে হতে পারে ৷ কিন্তু এই বিকল্প থিয়েটারে, আক্ষরিক অর্থে “পুওর থিয়েটার”-এর অনাড়ম্বর মঞ্চ উপস্থাপনার পক্ষে এগুলি অবশ্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা।

থার্ড থিয়েটার নাট্যশৈলির দিকে বাদল সরকারের এত বেশি যে, তিনি নিজেই বলেছেন, তাঁর অধিকাংশ নাটক এই থার্ড থিয়েটার ফর্ম ছাড়া অভিনয় করতে অসুবিধে আছে ৷

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : দর্শন চৌধুরী    
আরো পড়ুন :  সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম