রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ-এর বঙ্গভাষাভিধান

রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ-এর বঙ্গভাষাভিধান, বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান

আমাদের দেশে অভিধান-চর্চার শুরু এবং পরম্পরার একটা ধারা আছে–সে কারণেই অভিধানকে দেখতে হয় ইতিহাসের গতিধারায়, পূর্বাপর অভিজ্ঞতার নিরিখে। অভিধান কেবল ভাষাকে চেনায় না, সমাজ ও সভ্যতাকেও সে চিনতে শেখায়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ‘অভিধান ছাড়া মানুষ হয় না’—তা অনেকটা এই কারণে। স্বাভাবিকভাবে মানুষও যুগ যুগ ধরে তার মূল স্পর্শ করতে চেয়েছে। আর সেই সূত্রে মানুষ আজ আকাডিয়ান সাম্রাজ্যের সময়কার দ্বিভাষিক সুমেরীয় আকাডিয়ান শব্দমালাকেই সবচেয়ে প্রাচীন অভিধান বলে জেনেছে।

‘বঙ্গভাষাভিধান’ : বাঙালি রচিত বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান

আদ্যন্ত বাংলা অভিধানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮১৭ সালে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের হাত ধরে। পরে তার বিকাশ ঘটেছে বহু মানুষের চেষ্টায়। আজ বাঙালির হাতে এসেছে বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান। অভিধান নিয়ে বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এত বড় আয়োজন আগে দেখা যায়নি। তবু আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে প্রকাশিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের সেই অভিধানকে ঘিরে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। সেই সময়কার দাপুটে প্রকাশক স্কুল বুক সোসাইটি এই বইয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনার যাবতীয় দায়ভার গ্রহণ করে একটি ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পন্ন করেছিল। সেই প্রথম একটি খাঁটি বাংলা অভিধান হাতে এল বাঙালির। স্বাভাবিকভাবেই অভিধানটিকে আর পাঁচটা অভিধানের মতো নিছক একটি শব্দতালিকা হিসাবে দেখা হয়নি। তার সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতিকেও বড় করে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছে আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসাবে। একে ঘিরে গড়ে উঠেছিল একটা বিনম্র অহংকার।

রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ : বাংলা অভিধানকারের পরিচয়

প্রথম বাংলা অভিধানকার রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ খ্যাতনামা স্মার্ত্ত ও ব্রাহ্মসমাজের প্রথম আচার্য হিসেবে সকলের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৭৮৬ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ও ১৮৪৫ সালের ২ মার্চ তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাসে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় তাঁর বাল্যকাল ও ছাত্রজীবন সম্বন্ধে যে সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশিত হয় সেটি ছিল এইরকম—

“মহাত্মা শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ১৭০৭ শকের ২৯ মাঘ বুধবারে পালপাড়া নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার পিতা শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীনারায়ণ তর্কভূষণের চারি পুত্র, জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার, তিনি গার্হস্থ্য আশ্রম পরিত্যাগ-পূর্বক সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করিলে হরিহরানন্দনাথ তীর্থস্বামী কূলাবধৌতা নামে খ্যাত ছিলেন। মধ্যম পুত্রের নাম রামধন বিদ্যালঙ্কার, তিনি স্মৃতি শাস্ত্রে উৎকৃষ্ট রূপে ব্যুৎপন্ন ছিলেন, এবং আপন গৃহেতেই অধ্যাপনা করিতেন, তৃতীয় পুত্রের নাম রামপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, এবং শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ মহাশয় সর্ব কনিষ্ঠ ছিলেন। বিদ্যাবাগীশ মহাশয় ব্যাকরণাদি ব্যুৎপত্তি শাস্ত্র স্বীয় গ্রামেই অধ্যয়ন পূর্ব্বক কাশী প্রভৃতি পশ্চিমাঞ্চলের নানা স্থানে ভ্রমণ করেন। পরন্ত প্রত্যাগমনান্তর প্রায় পঞ্চবিংশতি বৎসর বয়ঃক্রমে শান্তিপুরস্থ রামমোহন বিদ্যাবাচস্পতি গোস্বামি ভট্টাচার্য্যের নিকটে স্মৃত্যাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলেন।

…হরিহরানন্দনাথ তীর্থস্বামী দেশ পর্যটন করত রঙ্গপুরে উপস্থিত হইয়া তত্রস্থ কালেক্টরির দেওয়ান রাজা রামমোহন রায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিলে রাজা তাঁহার শাস্ত্রচর্চা বিষয়ে অত্যন্ত আমোদ প্রযুক্ত তীর্থস্বামিকে মহা সমাদর পূর্বক আহ্বান করিলেন।… রামমোহন রায়… তীর্থস্বামীকে সমভিব্যাহারি করিয়া ১৭৩৪ শকে (১৮১৪/১৫) কলিকাতা নগরে আগমন করিলেন। এই কালে বিদ্যাবাগীশ মহাশয়ের অন্য অন্য ভ্রাতারা তাঁহার প্রতি অনেক প্রকার বিরাগ প্রকাশ করতে এবং তাঁহাকে পৃথক করিয়া দেওয়াতে তিনি অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হয়েন, এ প্রযুক্ত তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উক্ত তীর্থস্বামী রাজার নিকটে তাঁহাকে আনয়নপূর্ব্বক সাক্ষাৎ করাইয়া দিলেন। বিদ্যাবাগীশ মহাশয় অতিশয় বুদ্ধিমান, এবং সংস্কৃতভাষাতে শব্দালঙ্কারাদি ব্যুৎপত্তি শাস্ত্রে ও ধর্ম শাস্ত্রের অত্যন্ত ব্যুৎপন্ন প্রযুক্ত রাজা তাঁহাকে মহাপূর্বক গ্রহণ করিলেন। তিনি ঐ রাজার ইচ্ছানুসারে তাঁহার সমভিবাহারি শিবপ্রসাদ মিশ্র নামক একজন ব্যুৎপন্ন পণ্ডিতের নিকটে উপনিষৎ ও বেদান্ত দর্শনাদি মোক্ষ প্রযোজক শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন এবং তাঁহার স্বাভাবিক উজ্জ্বল মেধাবশতঃ অত্যন্ত কাল মধ্যে উক্ত শাস্ত্রে অসাধারণ সংস্কারাপন্ন হইলেন। প্রথমতঃ তিনি বঙ্গভাষাতে এক অভিধান ও জ্যোতিঃশাস্ত্রের একখণ্ড প্রকাশ করেন, এবং তাহা বিক্রয় দ্বারা কিঞ্চিৎ ধন সংগ্রহপুর্ব্বক পরিবারের বাসের জন্য শিমুলিয়ায় হেদুয়া পুষ্করিণীর উত্তরে এক বাটী ক্রয় করেন। পরন্ত তিনি রাজার নিকটে ক্রমশঃ অতিশয় প্রতিপন্ন হইয়া তাঁহার বিশেষ আনুকুল্য দ্বারা হেদুয়া পুষ্করিণীর দক্ষিণে এক চতুষ্পাঠী সংস্থাপনপূর্ব্বক কয়েক জন ছাত্রকে বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যাপনা করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহার শাস্ত্রজ্ঞান একপ্রকার উজ্জ্বল হইল, যে সাকার উপাসকদিগের সহিত রাজার যে সকল শাস্ত্রীয় বিচার উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাতে তিনিই প্রধান সহযোগী ছিলেন—রাজা তাঁহার পরামর্শ ব্যতীত কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করিতেন না। একপ্রকার ধর্মচর্চা জন্য তিনি ক্রমশঃ অত্যন্ত মান্য ও বিখ্যাত হইয়া উঠিলেন।”

—তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১বৈশাখ ১৭৬৭ শক।

১৮২৭ সালের মে মাসে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সরকার কর্তৃক সংস্কৃত কলেজের স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮২৭ সালের এপ্রিল মাসে পণ্ডিত কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন ২৪ পরগণা জেলা আদালতের জজ-পণ্ডিত নিযুক্ত হওয়ায়, কলকাতা গবর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত করবার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিলে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ আবেদন করেন এবং পনেরজন প্রার্থীর মধ্যে তিনি যোগ্যতম বিবেচিত হন। তিনি ১৮২৭ সালের ১৪ মে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজের স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

আরো পড়ুন :  আফসার আমেদ, সক্ষিপ্ত পরিচিতি

রামচন্দ্র দশ বৎসর সংস্কৃত কলেজে স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছিলেন। তারপর একটি অভাবনীয় ব্যাপারে তিনি পদচ্যুত হন। ঘটনাটি এইরকম ছিল—

“কালির বিশ্বম্ভর পণ্ডিতের জমিদারি সংক্রান্ত একটি মামলায়, গবর্নমেন্ট ১৮৩৬ সালে ১ আগস্ট দুটি প্রশ্ন পাঠিয়ে তার সম্বন্ধে সংস্কৃত কলেজের স্মৃতিশাস্ত্রধ্যাপকের অভিমত বা ব্যবস্থাপত্র চেয়ে পাঠান। ১৫ আগস্ট তারিখে ব্যবস্থাপত্র পাঠান, যে ব্যবস্থাপত্রে সংস্কৃত কলেজের অন্যান্য পণ্ডিতবর্গের স্বাক্ষর ছিল। এই ব্যবস্থাপত্র সকৌন্সিল গবর্নর জেনারেলের কাছে ভ্রমাত্মক মনে হওয়ায় তাঁকে কর্ম থেকে বরখাস্ত করা হয়।”

রামচন্দ্র সুবিচার লাভের আশায় বিলাতে কোর্ট অব ডিরেক্টরসের কাছে আবেদন করেছিলেন। তাঁদের বিবেচনায় তিনি নিরপরাধী সাব্যস্ত হলেও পূর্বপদ ফিরে পাননি। তাঁকে জানান হয়েছিল যে, ভবিষ্যতে কোনো পদ শূন্য হলে তাঁকে প্রথমে বিবেচনা করা হবে। ১৮৩৯ সালের জুন মাসে হিন্দু কলেজ সংলগ্ন বাংলা পাঠশালার ভিত্তি স্থাপন হলে হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশকে এই পাঠশালার প্রধান অধ্যাপক পদে নির্বাচিত করেন।

১৮৪১ সালের শেষদিকে সংস্কৃত কলেজের সহসম্পাদক মধুসূদন তর্কালঙ্কারের মৃত্যু হয়। রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ এই শূন্য পদের জন্য আবেদন করলে তাঁকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে কলেজ কর্তৃপক্ষ সংস্কৃত কলেজের সহসম্পাদক পদে নিযুক্ত করেন। এই পদে তিনি মৃত্যুকাল পর্যন্ত অর্থাৎ ২ মার্চ, ১৮৪৫ অবধি নিযুক্ত ছিলেন।

কিছুদিন সংস্কৃত কলেজে কাজ করবার পর বিদ্যাবাগীশ পীড়াগ্রস্ত হলে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর তাঁর মৃত্যু হয়। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ এইভাবে প্রকাশিত হয়—

“তিনি ১৭৬৫ শকের মাঘ মাসে পক্ষাঘাত রোগে পীড়িত হইলেন। তদবধি ইংরাজ ও বাঙ্গালি চিকিৎসক দ্বারা অনেক প্রকার চিকিৎসা হইয়াছিল, কিন্তু তাহাতে উপশম না হইয়া শরীর ক্রমশ অবসন্ন হইতে লাগিল। ইহাতে তিনি অনুভব করিলেন, যে কাশী অঞ্চলের জলবায়ু সুস্থতাদায়ক এবং তথায় উত্তম উত্তম মোসলমান চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা হইবারও সম্ভাবনা, অতএব তিনি ১৭৬৬ শকের ৯ ফাল্গুন বুধবার দিবা নয় ঘণ্টার সময়ে কাশী যাত্রা করিলেন। কিন্তু তথায় উত্তীর্ণ হইবার পূর্ব্বে পরমেশ্বর তাঁহাকে পীড়ার যন্ত্রণা হইতে মুক্ত করিলেন, এবং তিনি ছয় কন্যা মাত্র বর্তমান রাখিয়া গত ২০ ফাল্গুন রবিবার (২ মার্চ ১৮৪৫) দিবা অষ্ট ঘণ্টার সময়ে মুরশিদাবাদে ৫৯ বৎসর ২১ দিন বয়ঃক্রমে ইহলোক হইতে অবসৃত হইলেন।”

এতদ্ব্যতীত ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের প্রথম সচিব নিযুক্ত হয়ে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ একুশজন যুবককে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ-নিবারণ আন্দোলনে রামমোহনের বিপক্ষে যোগ দিলেও পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের আগে হিন্দু বিধবাবিবাহ প্রস্তাব সমর্থন এবং বহুবিবাহের বিরুদ্ধে নিজ মত নীতিদর্শন বক্তৃতামালায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন।

রাজা রামমোহন রায় বিলেতে গেলে দীর্ঘ দশ বছর তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বিষ্ণু চক্রবর্তীর সংগীতের জন্য ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব বজায় ছিল। তিনি বাঙালির শিক্ষা বাংলাভাষার মাধ্যমে সঠিকভাবে হবে বিশ্বাস করতেন। আদালতে ফারসি ভাষার পরিবর্তে বাংলা প্রচলনের উদ্দেশে সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে ছয় মাস প্রধান পণ্ডিতের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এই কাজে তিনি ডেভিড হেয়ার, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তির সমর্থন পান। তত্ত্ববোধিনী সভার (নামটি তাঁরই দেওয়া) সঙ্গে সংশিষ্ট থেকে সভার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের উন্নতির চেষ্টা করেন।

আরো পড়ুন :  মেঘনাদবধ কাব্যে বিধি ও বিশ্ববিধান, লেখা মোবাশ্বের আলী

বঙ্গভাষাভিধান : তথ্যের আলোকে

তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ১৮১৭ সালে প্রকাশিত (মতান্তরে ১৮১৮) ‘বঙ্গভাষাভিধান’ নামে প্রথম বাংলা অভিধান। এটাই বাঙালি রচিত প্রথম বাংলা অভিধান। কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটির প্রথম বার্ষিক বিবরণের (১৮১৭-১৮) ৮ম পৃষ্ঠায় এই অভিধান সম্বন্ধে নিম্নলিখিত বর্ণনা পাওয়া যায়—

“A small volume has recently appeared, the design and con- tents of which are stated in an English and Bengalee advertise- ment prefixed. The author, Ramchundur Surma, there remarks that he has constantly had occasion to observe in private cor- respondence and public documents written in Bengalee the deficiency of his countrymen (Pundits only excepted) in or- thography; which has induced him to collect as many Bengalee word as are derived from the Sanscrit, and are in most common use, and to publish them, with their definitions or synonymous words, in the form of a pocket volume. This little work therefore, under the name of Obhidhan, (vocabu- lary) is intended to instruct the natives both in the spelling and the meaning of terms.”

এই অভিধানের এক খণ্ড ইন্ডিয়া আপিস লাইব্রেরিতে আছে, কিন্তু তার আখ্যাপত্র নেই। স্কুল বুক সোসাইটির প্রথম বার্ষিক কার্য-বিবরণী থেকে জানা যায় প্রথম সংস্করণ অভিধানের সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। গ্রন্থকার তাঁর ভূমিকায় প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছেন যে, তাঁদের স্বদেশবাসীদের মধ্যে অনেকেই পত্র বা দলিলাদি-লিখনে সাধু শব্দের অভাব অনুভব করে থাকেন। এই অভাব দূরীকরণের জন্য তিনি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত প্রচলিত সকল বাংলা শব্দ সংগ্রহ করে তাদের মূল ও প্রতিশব্দসহ এই অভিধান সংকলন করেছেন। ১৮২০ সালে এই অভিধানের বর্দ্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইংলন্ডের ব্রিটিশ মিউজিয়মে এই সংস্করণের এক খণ্ড বই আছে। তালিকায় এইরকম বর্ণনা পাওয়া যায়—বঙ্গভাষাভিধান PP.IV.516, Cal.1820.12

রাধাকান্ত দেবের লাইব্রেরিতে এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগারে আখ্যাপত্রহীন এক এক খণ্ড বঙ্গভাষাভিধান আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫১৬ নয়। কলম সংখ্যা ৫১৬। প্রত্যেক পৃষ্ঠায় দুই কলম।

কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটির প্রথম রিপোর্টে আরো জানা যায় যে, উইলিয়ম কেরীর মতে অপরাপর সমজাতীয় এই ধরনের অভিধানগুলির মধ্যে এই অভিধানটি শ্রেষ্ঠ। স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃপক্ষ বিতরণের জন্য দুইশত অভিধান ক্রয় করেছিলেন।

১৮১৮-১৯ সলে প্রকাশিত স্কুল বুক সোসাইটির দ্বিতীয় বার্ষিক কার্যবিবরণীতে দেখা যায় রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের অভিধানের জনপ্রিয়তা লক্ষ করে প্রতি খণ্ড এক টাকা মূল্যে বিতরণের জন্য আরও দুইশত খণ্ড পুস্তক ক্রয় করেন। এই রিপোর্টে আরো জানা যায় যে আলোচ্য গ্রন্থের পরিবর্তিত ও পরিবর্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ মুদ্রণের জন্য স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন ও তাঁদের বিবেচনা অনুযায়ী উপযুক্ত মূল্যে গ্রন্থস্বত্ব বিক্রয়ের ইচ্ছাও জ্ঞাপন করেন। রিপোর্টটি এইরকম ছিল—

“Of the Obhidhan or Bengalee Vocabulary by Ramchondro Sormo, 200 copies were stated to have been purchased, at the rate of one rupee, in the Society’s first year. A purchase to the same extent has been made in the second; and experience proving the value and acceptableness of the work, your Com- mittee realily agreed to the Author’s proposal to prepare an enlarged and improved edition, (and with it to dispose of his right in the work) for such remuneration as the Committee of the society for the time being might judge equitable. The work, as now improved, will contain about thrice the number of works comprised in the first edition.. At the same time, by the use of a smaller type, and superior typographical skill, the size of the volume will remain the same. Your Committee,…have not hesitated to order an impression of 4000 copies. A few sheets have passed through the press, under the superinten- dence of Mr. Pearce”

—The Second Report of the Calcutta School-Book Society, for the year 1818-1819,pp.5-6.

স্কুল বুক সোসাইটি এই গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে পিয়ারসন সাহেবের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় সংস্করণ মুদ্রণ আরম্ভ করে ও চার হাজার খণ্ড মুদ্রণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। সোসাইটির তৃতীয় বার্ষিক কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় চার হাজার খণ্ডই মুদ্রিত হয়েছিল। প্রথম সংস্করণ অপেক্ষা দ্বিতীয় সংস্করণের শব্দসংখ্যা প্রায় তিন গুণ। এতে সর্বসমেত প্রায় ৩৫০০ শব্দ স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় সংস্করণের অক্ষরসমূহ প্রথম সংস্করণের অক্ষর অপেক্ষা ক্ষুদ্র ও পরিষ্কার। এই সংস্করণে ক্ষুদ্র অক্ষরে প্রতি পৃষ্ঠায় পাশাপাশি দুই সারি করে শব্দ মুদ্রিত করায় পৃষ্ঠা সংখ্যায় দুই সংস্করণ প্রায় সমান। এও জানা যায় যে, সোসাইটির কর্তৃপক্ষ আলোচ্য অভিধানের পরবর্তী সংস্করণে একটি পরিশিষ্ট সংযোগ করে তাতে নিত্য প্রয়োজনীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানবিষয়ক শব্দাবলী মুদ্রণের বিষয় বিবেচনা করছিলেন।

“…Of this work…4000 copies have been printed on account of the Society. It contains 3,500 Words including those comprised in the former edition; but being printed in a smaller type and ar- ranged in double columns, the size of the volume has not been materially increased.

The Committee have under their consideration the expediency of annexing to some future edition of this work, an appendix, containing the technical terms of art and science of most frequent occurrence in the Bengalee works published on account of the Society of under its patronage.”

—The Third Report of the Calcutta School-Book Society for the year 1819-1820.p.3.

এই অভিধানের শব্দসমূহ অ-কারাদি বর্ণানুক্রমে মুদ্রিত। এই সংস্করণের প্রতি পৃষ্ঠায় দুই কলম করে শব্দ মুদ্রিত হয়েছে এবং প্রত্যেক কলমের জন্য পৃথক পৃষ্ঠাঙ্ক নির্দেশ করা হয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থগারে রক্ষিত অভিধানের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫১৬ আকার 58 * 11 সেমি।

আরো পড়ুন :  রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত রচনা ও স্বীকৃতির চিঠি

অভিধানে প্রদত্ত শব্দাভিধানের নিদর্শনস্বরূপ কয়েকটি শব্দ উদ্ধৃত করা হল—

১. অনির্বিঘ্ন - অপ্রতুল গ্রস্ত পৃ.১৪

২. উৎপল - নালি পৃ.৭০

৩. কুন্দল - কলহ পৃ.১১০

৪. পুবাক - কলবিশেষ পৃ.১৩৪

৫. চপেট - বরতল পৃ.১৪৩

৬. তাহা - সেই পৃ.১৮২

৭. দারু - কাষ্ঠ পৃ.১৯৪

৮. নটী - বেশ্যা পৃ.২১৪

৯. নাই - অভাব, নাভি, নাপিত পৃ.২১৮

১০. নাটক - নৃত্যজী, কাব্যগ্রন্থ-বিশেষ, পৃ.২১৯

সোসাইটির চতুর্থ কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ মহাশয় ৩০০ টাকা (তিনশত টাকা) মূল্যে অভিধানটি স্কুল বুক সোসাইটিকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। জেমস্ লঙের তালিকায় এই অভিধানের প্রথম সংস্করণের প্রকাশ সাল ১৮১৮ এবং শেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫২ সালে। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত অন্যান্য গ্রন্থগুলি ‘জ্যোতিষ সংগ্রহসার’, বাচস্পতি মিশ্রের ‘বিবাদচিন্তামণিঃ’, ‘শিশুসেবধি’, ‘বর্ণমালা’, ‘নীতিদর্শন’, ‘পরমেশ্বরের উপাসনা বিষয়ে প্রথম ব্যাখান’ প্রভৃতি। মৃত্যুকালে ব্রাহ্মসমাজকে তিনি পাঁচ হাজার টাকা দান করেন।

দুইশত বৎসর আগে বাংলা অভিধানের যে সূচনা শুরু হয়েছিল তা আজ নানা রূপে মানুষের নানা প্রয়োজনে ছড়িয়ে পড়েছে।


[“বাংলা অভিধানের দুশো বছর ও তথ্যপঞ্জি ১৮১৭–২০১৭” (২০২২)—অসিতাভ দাশ ও প্রদোষকুমার বাগচী লিখিত, পত্রলেখা প্রকাশিত বই থেকে গৃহীত। “রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ও বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান” শীর্ষক রচনার সম্পাদিত ও সংক্ষেপিত রূপ]

রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ-এর বঙ্গভাষাভিধান
বাংলা অভিধানের দুশো বছর ও তথ্যপঞ্জি ১৮১৭–২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *