আনন্দময়ীর আগমনে


কাজী নজরুল ইসলাম

।। ধূমকেতু ।। ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ ।।

আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল ?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।

দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, – আসবি কখন সর্বনাশী?

দেব-সেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে,

রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে?

বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয় বছরী ফন্দি-কারায়,

চক্র তাহার চরকা বুঝি ভণ্ড-হাতে শক্তি হারায়।

মহেশ্বর আজ সিন্দুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে

অরবিন্দ চিত্ত তাঁহার ফুটবে কখন কে সে জানে।

সদ্য অসুর গ্রাসচ্যুত ব্রহ্মা চিত্তরঞ্জনে হায়

কমন্ডলুর শান্তি-বারি সিঞ্চি যেন চাঁদ নদীয়ায়।

শান্তি শুনে তিক্ত এমন কাঁদছে আরো ক্ষিপ্ত রবে,

মরার দেশের মড়া-শান্তি, সেত আছেই, কাজকি তবে;

শান্তি কোথায়? শান্তি কোথায় কেউ জানি না

মাগো তোর ঐ দনুজ-দলন সংহারিণী মূর্তি বিনা!

দেবতারা আজ জ্যোতিহারা ধ্রুব তাঁদের যায়না জানা,

কেউ বা দৈব-অন্ধ মাগো কেউ বা ভয়ে দিনে কানা।

সুরেন্দ্র আজ মন্ত্রণা দেন দানব রাজার অত্যাচারে,

দম্ভ তাঁহার দম্ভোলি ভীম বিকিয়ে দিয়ে পাঁচ হাজারে।

রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে

আরো পড়ুন :  কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কিত বইসমূহ Books About Kazi Nazrul Islam

সে কর শুধু পশল না মা অন্ধকারার বন্ধ-ঘরে।

গগন-পথে রবি-রথের সাত সারথি হাঁকায় ঘোড়া,

মর্তে দানব মানব-পিঠে সওয়ার হয়ে মারছে কোঁড়া।

বারি-ইন্দ্র বরুণ আজি করুণ সুরে বংশী বাজায়,

বুড়ি-গঙ্গার পুলিন বুকে বাঁধছে ঘাঁটি দস্যু রাজায়।

পুরুষগুলোর ঝুঁটি ধরে বুরুশ করায় দানব জুতো,

মুখে ভজে আল্লা হরি, পূজে কিন্তু ডান্ডা-গুঁতো।

দাড়ি নাড়ে, ফতোয়া ঝাড়ে, মসজিদে যায় নামাজ পড়ে,

নাইক খেয়াল গোলামগুলোর হারাম এসব বন্দী-গড়ে।

‘লানত’ গলায় গোলাম ওরা সালাম করে জুলুমবাজে

ধর্ম-ধ্বজা উড়ায় দাড়ি, ‘গলিজ’ মুখে কোরান ভাঁজে

তাজ-হারা যার নাঙ্গা শিরে গরমাগরম পড়ছে জুতি

ধর্ম-কথা বলছে তারাই পড়ছে তারাই কেতাব পুঁথি।

উৎপীড়কে প্রণাম করে শেষে ভগবানে নমি,

হিজরে ভীরুর ধর্ম-কথার ভন্ডামিতে আসছে বমি!

টিকটিকর ঐ ল্যাজুর সম দিগ্বিদিকে উড়ছে টিকি,

দেবতার আগে পূজে দানব, তাদের কাছে সত্য শিখি!

পুরুষ ছেলে দেশের নামে চুগ্ লি খেয়ে ভরায় উদর

টিকটিক হয়, বিষ্ঠা কি নাই – ছি ছি এদের খাদ্য ক্ষুধার!

আজ দানবের রঙমহলে তেত্রিশ কোটি খোজা-গোলাম

লাথি খায় আর চ্যাঁচায় শুধু, ‘দোহাই হুজুর মলাম মলাম’।

মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি নাকি

আরো পড়ুন :  কুন্তলীন পুরস্কারের সূচি

খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।

হান্ তরবার, আন্ মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,

—————————————-
আরো পড়ুন – সম্পাদক নজরুল
—————————————-

মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ রক্ত দে মা রক্ত দেখা

লক্ষ্মী-সরস্বতীকে তোর আয় মা রেখে কমল-বনে,

বুদ্ধি-বুড়ো সিদ্ধিদাতা গণেশ-টনেশ চাই না রণে।

ঘোমটা-পরা কলা-বউ-এর গলা ধরে দাও করে দূর,

ঐ বুঝি দেব-সেনাপতি, ময়ূর চড়া জামাই ঠাকুর?

দূর করে দে, দূর করে দে এসব বালাই সর্বনাশী,

চাই নাকঐ ভাং-খাওয়া শিব, নেক নিয়ে তাঁর গঙ্গামাসী।

তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে,

রক্ত-তৃষায় ‘ময় ভুখা হুঁ’র কাঁদন-কেতন কন্ঠে ধরে

‘ময় ভুখা হুঁ’র রক্ত ক্ষেপী ছিন্নমস্তা আয় মা কালী,

গুরুর বাগে শিখ সেনা তোর হুঙ্কারে ঐ ‘জয় আকালী’।

এখনো তোর মাটির গড়া মৃণ্ময়ী ঐ মূর্তি হেরি,

দু’চোখ পুরে জল আসে মা, আর কতকাল করবি দেরী?

মহিষাসুর বধ করে তুই ভেবেছিলি রইবি সুখে,

পারিসনি তা, ত্রেতাযুগে টলল আসন রামের দুখে।

আর এলিনে রুদ্রাণী তুই জানিনে কেউ ডাকল কিনা,

রাজপুতনায় বাজল হঠাৎ ‘ ময় ভুখা হুঁ’র রক্ত বীণা।

বৃথাই গেল সিরাজ টিপু মীর কাসিমের প্রাণ বলিদান,

আরো পড়ুন :  নজরুলের গ্রন্থ উৎসর্গসহ [Bibliography of Kazi Nazrul Islam]

চণ্ডি! নিলি যোগমায়া-রূপ, বলল সবাই বিধির বিধান।

হঠাৎ কখন উঠল ক্ষেপে বিদ্রোহিণী ঝান্সি-রানী,

ক্ষ্যাপা মেয়ের অভিমানেও এলিনে তুই মা ভবানী,

এমনি করে ফাঁকি দিয়ে আর কতকাল নিবি পূজা?

পাষান বাপের পাষান মেয়ে, আয় মা এবার দশভুজা।

বছর বছর এ অভিনয়, অপমান তোর, পূজা নয় এ,

কি দিস আশিস্ কোটি ছেলের প্রণাম চুরির বিনিময়ে।

অনেক পাঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,

আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।

দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন-শক্তি পূজা

দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে মা দশভুজা।

সেই দিন জননী তোর সত্যিকারের আগমনী,

বাজবে বোধন-বাজনা সেদিন গাইব নব জাগরনী।

‘ময় ভুখাহুঁমায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী

কৈলাস হতে গিরি-রানীর মা-দুলালী কন্যা অয়ি!

আয় উমা আনন্দময়ী।

কাজী নজরুল ইসলাম
ধূমকেতু, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *