পুথি প্রসঙ্গ 

চিত্র : চর্যাপদের পুথি


আলোচ্য বিষয়: পুথি, পুথির শ্রেণি, কয়েকটি পুথির নিদর্শন

** পুথি কী ?
পুথি বা পুঁথি প্রাচীনকালের রচিত হস্তলিখিত গ্রন্থ। পুরোনো যুগে অর্থাৎ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে লিখিত সাহিত্যের একমাত্র বাহন ছিল হাতে লেখা পুথি বা বলা চলে পাণ্ডুলিপি। সেইসময়ে এই পুথির মাধ্যমেই কবিদের জ্ঞানানুশীলনের প্রকাশ ঘটতো। এখন আমাদের ভাবতে অবাক লাগে শুধুমাত্র হাতে লেখা পুথি দিয়েই তাঁরা বিদ্যাচর্চায়  নিজেদের নিয়োজিত রাখতো।

** পুথি শব্দটি কিভাবে এলো ?
পুথি < পুস্তক। প্রাচীনকালে হাতে লেখা বইকে বলা হতো ‘পুস্তক’(সংস্কৃত শব্দ)। এই শব্দ থেকেই তদ্ভব ‘পুথি’ শব্দের উৎপত্তি। এবং অনেকেই পুথিকে ‘পুঁথি’ লেখেন। আসলে এটি স্বতো-নাসিক্যিভবনের ফলে সম্ভব হয়েছে। ‘পুস্তক’ শব্দটির আগমন ঘটেছে ‘পোস্ত’ বা ‘পুস্ত’ শব্দ থকে। এই ‘পোস্ত’ শব্দের অর্থ চামড়া। প্রথম দিকে চামড়ার উপর লেখা হত বলে প্রাচীনযুগের সাহিত্য-সম্ভারের আধারকে বলা হতো ‘পুস্তক’ ; যা থেকে পরে ‘পুথি’ শব্দটি এসেছে।

** পুথির শ্রেণি
প্রাপ্ত পুথির প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে আমরা পুথিকে মোটামুটি দুটি শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি –
ক। আদর্শ পুথি
খ। অনুলিখিত পুথি

** আদর্শ পুথি কী ?
কবি বা লেখকেরা অনেকসময়ই নিজেদের কাব্য বা রচনা নিজেরাই লিখতেন। কবির স্বহস্ত লিখিত সেই পুথিকেই বলা হয় আদর্শ পুথি। সাধারণত আদর্শ পুথি ছিল সবথেকে মূল্যবান। স্বযত্নে এই পুথি রক্ষার কাজ চলতো। যদিও সময়ের কালগ্রাসে পুথিগুলি নষ্ট হয়ে যেত।

** অনুলিখিত পুথি কী ?
লিপিকরের দ্বারা কবির লিখিত মূল পুথির যে অনুলিপি প্রস্তুত হতো তাকে বলা হয় অনুলিখিত পুথি। স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যায় এই ধরনের পুথিই বেশি পাওয়া যায়। লিপিকরদের সেসময়ে বেশ কদর ছিল। হস্তলিপিবিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিরা বেশ সহজেই রাজসভায় কাজ পেয়ে যেত। এইধরনের পুথিগুলিকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—

১। সুরক্ষিত প্রতিলিপি – লিপিকর যখন সতর্কতার সঙ্গে মূল পুথি অনুলিখন করে যে পুথি লেখেন।
২। অরক্ষিত প্রতিলিপি – লিপিকর যখন স্বাধীনভাবে অনুলিখন করেন।

৩। সংশোধিত প্রতিলিপি – লিপিকর যখন সংশোধন চিহ্ন প্রয়োগ করে পুথির শুদ্ধপাঠ রচনা করেন।


কয়েকটি পুথির নিদর্শন

১। দ্বাদশ শতকের পুথি –    
চর্যাপদ (গানগুলি পুরনো বাংলা হরফে আর
টীকা দেবনাগরীতে লেখা)
রামচরিত (সন্ধ্যাকর নন্দীর লেখা )
সুভাষিত রত্নকোষ

২। ত্রয়োদশ শতকের পুথি – 
পঞ্চরক্ষার পুথি (সংস্কৃত ভাষায় লেখা । ১২১১ শকাব্দে রচিত)

৩। চতুর্দশ শতকের পুথি –   
দায়ভাগের পুথি (জীমূতবাহন কর্তৃক রচিত । সংস্কৃত ভাষায়)

৪। পঞ্চদশ শতকের পুথি – 
কুসুমাঞ্জলি  টীকা (বর উপাধ্যায় কর্তৃক রচিত সংস্কৃত ভাষা ১৩৩২ শকাব্দে রচিত)

৫। ষোড়শ শতকের পুথি –
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুথি (সাহিত্য পরিষদে সংরক্ষিত)

৬। ১৭শ শতকের পুথি –   
মহাভারতের আদিপর্ব (কাশীরাম দাস রচিত সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত)

৭। ১৮শ শতকের পুথি –    
মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব (জৈমিনি রচিত অনুলিখনের তারিখ ১১৭৫ সাল সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত)

                           
সতীময়না (দৌলত কাজী। ১৭৪৫ খৃঃ)

৮। ১৯শ শতকের পুথি –    চণ্ডীমঙ্গল (মুকুন্দ চক্রবর্তীর লেখা। অনুলিখন ১১২৪-২৫ সাল)


** পরবর্তী পর্বগুলিতে যা থাকবে

পুথির উপকরণ, পুথি লেখার পদ্ধতি, পুথির হরফ বা অক্ষর, পুথির কালনির্নয়ের পদ্ধতি, পুথির পুস্পিকা, পুথির চিত্র, পুথি সম্পাদনা, পুথিশালা, পুথি সংরক্ষণ পদ্ধতি, রবীন্দ্রনাথের পুথিবিদ্যাচর্চা


আরো পড়ুন :  প্রসঙ্গ পুথি ২য় পর্ব

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *