চুম্বক :
- শৌখিন নাটকাভিনয়
- দ্বারকানাথ ঠাকুর-রামমোহন রায়
- বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-বঙ্কিমচন্দ্র
- বাঙালি মনীষীদের অভিনয় ও পৃষ্টপোষকতা
সংস্কৃতির একটি দিক যেমন অভিনয়, চিত্ত-বিনোদনের একটি প্রকৃষ্ট উপকরণও তেমনি অভিনয়-দর্শন। তাই সাধারণ-অসাধারণ সব ব্যক্তিই অভিনয় দেখে আনন্দ পান। বাঙালি মনীষীদের মধ্যে অনেকেই শৌখিন নাট্যাভিনয় দেখতে ভালোবাসতেন। অভিনয়-শিল্পের প্রতি তাদের আন্তরিক মমতা এবং সহযোগিতা ছাড়া, শৌখিন নাট্যাভিনয়ের বর্তমান রূপ আমরা দেখতে পেতাম না।
চৌরঙ্গী থিয়েটার প্রতিষ্ঠা এবং অভিনয়-অনুষ্ঠানের সঙ্গে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। অভিনয়-শিল্পের প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের আন্তরিক আগ্রহ ছিল। শকুন্তলা নাটকটিকে তিনি ভারতবর্ষে রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক বলে মনে করতেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ফ্যানি নামে এক অভিনেত্রীর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা হয়। ফ্যানি তাঁর ২৬ ডিসেম্বর ১৮৩১ তারিখের দিন লিখেছেন, রাজা তাদের ইজাবেলা নাটকের অভিনয় দেখে ক্রন্দন করেন। রামমোহনের একটি পত্রে [১২ ই জুন ১৮৩৩] জানা যায় যে, তিনি আসলিস থিয়েটারেও অভিনয় দেখতে গিয়েছিলেন।
কালীপ্রসন্ন সিংহের নাম এদিক থেকে বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। তিনি যেমন নাট্যাভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন, নিজেও তেমনি ছিলেন একজন দক্ষ অভিনেতা। ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গ-মঞ্চ’ তাঁরই সৃষ্টি। এই মঞ্চে অভিনীত ‘বেণীসংহার’ নাটকে অভিনয় করে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ‘বিক্রমোর্বশী’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন।
বিদ্যাসাগর, মধুসূদন এবং বঙ্কিমচন্দ্র নাট্যাভিনয়ে উৎসাহী ছিলেন। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বাড়িতে থিয়েটারের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন তার কার্যকরী সদস্য ছিলেন। সংস্কৃত নাটকের ভাবাদর্শে রচিত একটি বাংলা নাটকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লিখতে গিয়ে বাংলা ভাষায় রচিত ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গ’ দেখে মধুসূদন আঘাত পেয়েছিলেন এবং সেই সূত্রেই তাঁর হাতে প্রথম সার্থক বাংলা নাটক ও প্রহসন রচিত হয়। বাংলা সাহিত্য এবং মধুসূদনের জীবনে এটি একটি স্মরণীয় অধ্যায়। নাট্যাভিনয় না করলেও, মধুসূদন কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হিন্দু কলেজের পুরস্কার বিতরণী সভায় নাট্যাংশ আবৃত্তি করেছিলেন। এই শ্রুতিনাটকে ষষ্ঠ হেনরী এবং গ্লার্স্টর রূপে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন যথাক্রমে ইশ্বরচন্দ্র ঘোষাল ও মধুসূদন দত্ত।
নীলদর্পণ নাটকের অভিনয় দেখে বিচলিত দর্শক বিদ্যাসাগরের চটি-জুতো ছুঁড়ে মারার ঘটনাটি অভিনয় জগতে একটি স্মরণীয় দৃষ্টান্ত। নীলদর্পণ নাটকের প্রথম অভিনয়কে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম সাধারণ নাট্যশালা ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। উদ্যোক্তা ছিলেন গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, নগেন্দ্রনাথ প্রমুখ। প্রথম অভিনয় রজনীতে (৭ডিসেম্বর ১৮৭২) দীনবন্ধু মিত্রের বিশেষ আগ্রহে দর্শকরূপে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যাসাগর। ইংরেজ কুঠিয়াল অত্যাচারী রোগ সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। আত্মমগ্ন দর্শক বিদ্যাসাগর চটি খুলে রোগ সাহেবকে ছুঁড়ে মারেন। প্রেক্ষাগৃহে এ নিয়ে তুমুল উত্তেজনা হয়। সাময়িকভাবে অভিনয়ও বন্ধ হয়। তারপর বিদ্যাসাগরের সেই চটি মাথায় ধারণ করে অর্ধেন্দুশেখর মঞ্চে এসে বলেন — এই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
‘অভিনয় দ্বারা মানব কল্যাণ সাধন কেশবচন্দ্র সেনের জীবনের ব্রত ছিল।’ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, অভিনয়ের সাহায্যে নীতি এবং সমাজ সম্বন্ধে সংস্কার অতি সহজে নিষ্পন্ন হয়। নাট্যাভিনয়েও কেশবচন্দ্র পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। হিন্দু কলেজে ছাত্রাবস্থায় তিনি হ্যামলেট নাটকের হ্যামলেট-এর ভূমিকা এবং পরবর্তী জীবনে নববৃন্দাবন নাটকে অভিনয় করেছেন। সেন পরিবারের যুবকদের প্রচেষ্টায় যে ‘মেট্রোপলিটন থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হয় তার মধ্যে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন মুরলীধর সেন ও কেশবচন্দ্র সেন। রমেশচন্দ্র মিত্রের জ্যেষ্ঠ সহোদর উমেশচন্দ্র যে বিধবা বিবাহ নাটক রচনা করেন, তার অভিনয়-অনুষ্ঠান হয় গোপাল মল্লিকের রাজপ্রাসাদ এবং পাইকপাড়া রাজবাড়ীতে। পরবর্তী কালে এই নাটকের দুবার অভিনয় অনুষ্ঠিত হয় মেট্রোপলিটন থিয়েটারের। কেশবচন্দ্র এই নাটকের মঞ্চাধ্যক্ষ ছিলেন। বিদ্যাসাগর এই অভিনয় দেখেও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র এবং সাহিত্যাচার্য অক্ষয়চন্দ্র সরকার শুধু অভিনয় দেখেই পরিতৃপ্ত হতেন না। শৌখিন নাট্যাভিনয়েও তাদের উদ্যোগ কম ছিলনা। ১৮৭২ সালের ৩০ মার্চ চুঁচুড়ায় দীনবন্ধু মিত্রের লীলাবতী নাটকের অভিনয় হয় প্রধানত তাদেরই প্রচেষ্টায়। এই নাটকে অক্ষয়চন্দ্র ও সঞ্জীবচন্দ্রের কয়েকটি গান সন্নিবিষ্ট হয়। কলকাতার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার দল চুঁচুড়ায় অভিনয় করলে, অভিনেত্রী গোলাপির অভিনয়ে সন্তুষ্ট হয়ে গুণমুগ্ধ দর্শক বঙ্কিমচন্দ্র একছড়া সোনার হার পুরস্কার দিয়েছিলেন। আর এক অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী ‘আমার কথা’য় লিখেছেন–
একদিন বঙ্কিমবাবু তাঁহার মৃণালিনী অভিনয় দেখিতে আসিয়াছিলেন, সেই সময় আমি মৃণালিনীতে মনোরমার অংশে অভিনয় করিতেছিলাম। মনোরমার অংশ অভিনয় দর্শন করিয়া বঙ্কিমবাবু বলিয়াছিলেন যে, আমি মনোরমার চরিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম কখন যে ইহা প্রত্যক্ষ দেখিব তাহা মনে ছিল না। আজ মনোরমাকে দেখিয়া আমার মনে হইল যে আমার মনোরমাকে সামনে দেখিতেছি।
বঙ্গরঙ্গমঞ্চের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সূদৃঢ় সংযোগ ছিল। তাঁর সস্নেহ প্রেরণায় অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামের যাত্রাভিনয়ে একবার ‘শিব’ চরিত্রাভিনেতা অনুপস্থিত থাকায় তাঁকে শিব সাজানো হয়। রামকৃষ্ণদেবের ধীর গম্ভীর পদক্ষেপ এবং ঢুলুঢুলু নয়নের দৃষ্টি দর্শকদের মোহিত করে।
শিবনাথ শাস্ত্রী একস্থানে লিখেছেন—‘অভিনয় দেখা আমার বাতিক।’ ১৮৬১ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির নাট্যমঞ্চে সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা যে সংস্কৃত নাটক ‘বেণীসংহার’ অভিনয় করেন, শিবনাথ তাতে যুধিষ্ঠিরের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র একজন কুশলী অভিনেতা ছিলেন। ভোলানাথ চন্দ, গৌরদাস বসাক, রমানাথ লাহা প্রমুখ খ্যাতনামারা সুঅভিনয় করতেন। সুবিখ্যাত চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর তাঁর ভ্রাতা রাধামাধব-এর মতই সুঅভিনয় করতেন।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও অভিনয় করতেন। মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক-অভিনয়ে তিনি শর্মিষ্ঠার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন। দর্শকরূপে উপস্থিত মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর উমেশচন্দ্রের অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রাসাদে বিক্রমোর্বশী নাটকেও উমেশচন্দ্র অভিনয় করেছেন। তার অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রীর জন্য স্ত্রীর ভূমিকায় তাঁকে অনবদ্য মানাতো।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
শৈলেন কুমার দত্ত [শারদীয় পরিবর্তন]