শিক্ষাষ্টক / শিক্ষাশ্লোকাষ্টক [শ্রীচৈতন্যদেব]
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের একমাত্র রচনা নিদর্শন বলে কথিত ‘শিক্ষাষ্টক’ [শিক্ষাশ্লোকাষ্টক] -এর শ্লোকগুলি কবিরাজ কৃষ্ণদাস গোস্বামী তাঁর “শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থের অন্তলীলার বিংশ পরিচ্ছেদে বঙ্গানুবাদ সহ উদ্ধৃত করেছেন। মূল শ্লোকগুলি কবিরাজ গোস্বামী শ্রীরূপগোস্বামীর সংকলন গ্রন্থ “পদ্যাবলী” থেকে গ্রহণ করেছেন।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ-এর মতে লীলাজীবনের শেষের দিকে শ্রীচৈতন্যদেব লোকশিক্ষা দিতে এগুলি নিজেই উচ্চারণ করে আস্বাদ করতেন। শ্লোকগুলি বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে — শ্লোকগুলির প্রথম তিনটি এবং ৬নং টি নামমহিমা এবং নামকীর্তন-এর গুরুত্ব বিষয়ে। বাকিগুলি প্রীতিভাব এবং দাস্যভাব নিয়ে রচিত।
শ্লোক = ১
চেতোদর্পণ-মার্জন ভব-মহাদাবাগ্নি-নির্বাপনং
শ্রেয়ঃ কৈরব-চন্দ্রিকা-বিতরং বিদ্যাবধূ-জীবনং। আনন্দাম্বুধি-বর্ধনং প্রতিপদং পূর্ণামৃতাস্বাদনং
সর্বাত্ম-স্নপনংপরং বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণ-সংকীর্তনং।।
ব্যাখ্যার্থ :
ব্রহ্মাস্বাদ বিষয়ে মহর্ষিরা উপনিষদ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্রে যেসব বর্ণনা দিয়েছেন সেই ব্রহ্মের আস্বাদ হরিনাম সংকীর্তন-এর মধ্য দিয়ে অক্লেশে লভ্য, মহাপ্রভু এই শ্লোকের বর্ণনায় তা জানালেন।
চিত্তদর্পন-এর মার্জনাকারী, ভব-দাবাগ্নি নির্বাপনকারী, কল্যান-কুমুদে চন্দ্রালোক বিতরনকারী, বিদ্যাবধূর জীবনস্বরূপ, আনন্দাম্বুধি বর্ধনকারী, প্রতিপদে পূর্ণ অমৃত আস্বাদনকারী, সর্বেন্দ্রিয় তৃপ্তিকারী শ্রীকৃষ্ণ-সংকীর্তন জয়যুক্ত হলো।
চিত্তরূপদর্পণ, যাতে বাসনাসমূহের প্রতিবিম্ব পড়ে, তার মালিন্য হরিসংকীর্তন-এ নিঃশ্বেষে মার্জিত হয়ে যায়। যে সংসারজ্বালা থেকে দুর্বহ দুঃখ জন্ম নিয়েছে তা নামে-রুচি হলেই দূরে চলে যায়। উপনিষদ যে শ্রেয়ঃকে চরম প্রাপ্তব্য বলে উল্লেখ করেছে, সেই শ্রেয়ঃর লাবণ্যবর্ধক হল এই নাম সংকীর্তন। বিদ্যা বা শুদ্ধ জ্ঞানের [বিদ্যারূপ কাম্যবধূর] প্রাণ হলো এই নাম সম্পদ।এমন হরিনামকীর্তন জীবের সহজে কৃষ্ণলাভের জন্য পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হোক।
শ্লোক = ২
নাম্নানকারি বহুধা নিজসর্বশক্তি–
স্তত্রার্পিতা নিয়মিতঃ স্মরণে ন কালঃ।
এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন! মমাপি
দুর্দৈবমীদৃশমিহাজনি নানুরাগঃ।।
ব্যাখ্যার্থ :
ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন রুচি অনুসারে তুমি নিজেকে বহুনামে প্রচার করেছো। এবং সেই নামসমূহে সর্বশক্তি অর্পণ করেছ। সেই নাম স্মরণের কালাকাল বিচার করনি। ভগবন, তোমার এত কৃপা! কিন্তু আমার এহেন দুর্দৈব যে এতে অনুরাগ জন্মালো না।
ভিন্ন ভিন্ন জীবের বিভিন্ন মনোবৃত্তি অনুসারে ভগবন নিজেকে, হরি-কৃষ্ণ-গোবিন্দ-মাধব-শ্যাম প্রভৃতি অনন্ত নামে প্রকাশিত করেছে। এই শ্লোকে নামের সঙ্গে নামীর অভেদ, ঈশ্বরের কারুণ্য ব্যঞ্জিত হয়েছে।
শ্লোক = ৩
তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।
শ্লোকার্থ ও ব্যাখ্যা :
তৃণ থেকেও নিচে নেমে, তরু থেকেও সহিষ্ণু হয়ে, অমানীকেও মান দিয়ে, সর্বদা হরিনাম করবে।
তৃণের চেয়েও অবনত যিনি, যিনি তরুর মতই সহিষ্ণু, যিনি (মানী হলেও) মান বিসর্জন দিয়েছেন অথবা মান যার কোনকালেই নেই অথচ যিনি অন্যকে যথাযোগ্য মানমর্যাদা প্রদর্শন করেন এমন ব্যক্তিই হরিস্মরণের যোগ্য, প্রকৃত বৈষ্ণব।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন,
উত্তম হঞা আপনাকে মানে তৃণাধম।
দুই প্রকারে সহিষ্ণুতা করে বৃক্ষসম।।
*************************
উত্তম হঞা বৈষ্ণব হবে নিরভিমান।
জীবের সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ-অধিষ্ঠান।।
শ্লোক = ৪
ন ধনং ন জনং সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি।।
ব্যাখ্যার্থ :
হে জগদীশ, আমি ধন, জন, সুন্দরী বা কবিতা কামনা করি না। জন্মে জন্মে তোমার প্রতি অহৈতুকী ভক্তি কামনা করি।
লোক শিক্ষার্থে মহাপ্রভু জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষ তোমার কাছে যা চায় তা হল ধন, জন, সুন্দরী স্ত্রী, কবিত্ব বা বিদগ্ধতা— এইসব। তারা তোমাকে চায় না। হে ঈশ্বর, আমার যেন জন্মে জন্মে তোমাতেই শুদ্ধ ভক্তি থাকে।
শ্লোক = ৫
অয়ি নন্দতনুজ কিঙ্করং পতিতং মাং বিষমে ভবাম্বুধৌ।
কৃপয়া তব পাদপঙ্কজস্থিত ধূলীসদৃশং বিচিন্তয়।।
শ্লোকার্থ ও ব্যাখ্যা :
হে নন্দনন্দন, তোমার কিংকর আমি বিষম সংসার-সাগরে পতিত হয়েছি, কৃপা করে আমাকে তোমার পদপঙ্কজস্থিত ধূলিস্বরূপ গন্য কর।
জগদীশকে প্রিয় সম্বোধন দ্বারা সুদুর্লভ দাস্যভক্তির জন্য প্রার্থনা। ঈশ্বরের কৃপা-কনিকালাভ থেকে কে বঞ্চিত হতে চায়। পাদপঙ্কজে যেমন রেণু থাকে, সেই একটি রেণু হবার সৌভাগ্য আমাকে দাও।
শ্লোক = ৬
নয়নং গলদশ্রু ধারয়া বদনং গদগদ-রুদ্ধয়া গিরা। পালকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি।।
শ্লোকার্থ ও ব্যাখ্যা :
তোমার নামগ্রহণে কবে আমার নয়নে দরদর বেগে অশ্রুধারা প্রবাহিত হবে, গদগদ ভাবে কবে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হবে এবং কবে পুলকে সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে।
নাম প্রীতিই যে কৃষ্ণপ্রীতি এখানে প্রকারান্তরে তাও বোঝানো হলো।
শ্লোক = ৭
যুগায়িতং নিমেষেণ চক্ষুষা প্রাবৃষায়িতং।
শূন্যায়িতং জগৎ সর্বং গোবিন্দ-বিরহেণ মে।।
শ্লোকার্থ ও ব্যাখ্যা :
গোবিন্দ বিরহে আমার কাছে নিমেষমাত্র সময় যুগ বলে মনে হচ্ছে। চোখে বর্ষার বারিধারা বইছে এবং সমস্ত জগৎ শূন্যময় বোধ হচ্ছে।
চণ্ডীদাসের পদাবলীতেও রাধার এই বিরহভাব ফুটেছে। কবিরা কল্পনায় যা বর্ণনা করেছেন মহাপ্রভুতে তা প্রত্যক্ষতা দেখে রাগভক্তির যথার্থতা অনুধাবনীয়।
শ্লোক = ৮
আশ্লিষ্য বা পাদরতাং পিনষ্টুমা—
মদর্শনান্মর্ম্মহতাং করোতু বা।
যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো
মৎপ্রাণনাথস্ত স এব নাপরঃ।।
ব্যাখ্যার্থ :
পরম-আদরে আমাকে আলিঙ্গন করে আত্মসাৎ করুক, বা দেখা না দিয়ে আমাকে মর্মাহত করুক, বা সেই লম্পট যেখানে সেখানে বিহার করুক, তবুও সেই আমার প্রাণনাথ অন্য কেউ নয়।
‘শিক্ষাশ্লোক’গুলি ‘পদ্যাবলী’তে যে ক্রমানুসারে বিবৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ তা অনুসরণ করেননি। তিনি ভাবসঙ্গতির দিক থেকে সাজিয়ে নিয়েছেন। আর মহাপ্রভু কোন সময় কোন শ্লোকটি রচনা করেছিলেন তা জানবার কোন উপায় এখন নেই।।
ঋণ :
বৈষ্ণব-রস-প্রকাশ – ক্ষুদিরাম দাস
বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়: নবপর্যায় – নীলরতন সেন