[ads id =”ads1″]

ভুসুকুপাদ একজন শক্তিমান চর্যাকার ৷ কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব ও প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিতর্ক আছে ৷ চর্যাগীতির রচনা-কাল বিচারে এবং মহাযান মধ্যমক মতের সঙ্গে সহজ-তান্ত্রিক শাখার সম্পর্ক বিচারে ভুসুকুপাদের জীবন-বৃত্ত প্রভূত আলোক- সম্পাত করে ৷ শূন্যবাদের শেষস্তর সহজিয়া তান্ত্রিকতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ৷ শেষ পর্যন্ত মহাযানের সকল মতই সহজ-সাগরে মিলিত হয়ে হেবজ্রতন্ত্রের ‘সহজং জগৎ সর্বং’ মহাবাক্যটিকেই যেন সার্থক করে তোলে ৷ পদকর্তা ভুসুকুর জীবন এই সত্যের স্মারক ৷


সময়কাল


ভুসুকু (শান্তিদেব) সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর ভিতর বর্তমান ছিলেন।

কোন অঞ্চলের অধিবাসী?? 


  • তারানাথ শান্তিদেবকে (ভুসুকু) সৌরাষ্ট্রের অধিবাসী বলেছেন।
  • হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অনুমান, ইনি ‘ভারতের পূর্বাঞ্চলের লোক’।
  • অনেকেই ভুসুকুকে বাঙালি বলতে চেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তকার অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাঙালি’ দাবি সমর্থন করেন।


‘বাঙালি’ এই দাবির প্রত্যক্ষ সমর্থন 


১. ভুসুকু নিজের গানেই বলেছেন,

“আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।” ৪৯ নং

এই ‘বঙ্গালী’ (অর্থ ব্রাত্য) পদের উল্লেখ এই দাবিকেই জোরালো করে।

২. ভুসুকুর গানে পাদ্মাখালে নৌ-যাত্রার যে চিত্র (৪ নং পদ) দেখি তাতে তিনি বঙ্গদেশের বলেই মনে হয়।

৩. ‘অপণা মাংসে হরিণা বৈরী’ জাতীয় বঙ্গীয় বাগবিধি লক্ষ্যণীয়।

——————————————————————
আরো দেখুন — চৌরাশী সিদ্ধা
——————————————————————-


ভুসুকু সম্বন্ধে সুকুমার সেনের মত :


সুকুমার সেন বলেন, 

ভুসুকু চর্যাকর্তাদের মধ্যে বেশ অর্বাচীন ৷ পারিভাষিক শব্দের বাহুল্য এবং সন্ধ্যা-সঙ্কেতের আড়ম্বর চর্যাগীতির অনুশীলনে দীর্ঘ গতানুগতিকতারই দ্যোতক। 

তিনি আরও বলেন, 

ভুসুকুর জীবৎকালের নিম্নতম সীমা ১২৯৫ খ্রীষ্টাব্দ। এই বৎসরে নকলকরা ভুসুকুর ‘ চতুরাভরণ’ গ্রন্থের পুথি পাওয়া গিয়াছে।


★★ কোনো গ্রন্থের প্রাচীন অনুলিপির তারিখ ধরে গ্রন্থকারের কালনির্ণয় করা সম্ভব নয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ (প্রায় চতুর্দশ শতাব্দীই বলা চলে) ভুসুকুর জীবৎকালের নিম্নতম সীমা হলে কমপক্ষে দ্বাদশ শতকে সঙ্কলিত চর্যাগীতিকোষে ভুসুকুর স্থান হয় কিরূপে ? হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং Sneligrove প্রমুখ পণ্ডিতেরা স্বীকার করেছেন, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে যত মহাযান-বজ্রযানের ভাষ্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে, সেগুলি তাঞ্জুর তালিকায় উদ্ধৃত হয়েছে ৷ মুনিদত্ত-কৃত ‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি’ এরূপ একটি গ্রন্থ৷ ভুসুকুর চর্যা তাতে আছে ৷ তা হলে ভুসুকু কি দ্বাদশ শতকের পরে আরও প্রায় দুশো জীবিত ছিলেন? ★★


শান্তিদেব ও ভুসুকু কি একই ব্যক্তি? 


আচার্য হরপ্রসাদ শাস্তী বৌদ্ধগান ও দোহার মুখবন্ধে ‘শিক্ষাসমুচ্চয়’ ও ‘বৌদ্ধিচর্যাবতার’ গ্রন্থের রচয়িতা শান্তিদেবের যে পরিচয় দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, শান্তিদেব, রাউতু ও ভুসুকু একই ব্যক্তি। চর্যাগানে ভুসুকুরও বিশিষ্ট ভনিতা — ‘রাউতু-ভণই কট’ (৪১, ৪৩)।  ভুসুকু ও শান্তি যে একই ব্যক্তি–নারোপাকৃত সেকোদ্দেশটীকায় উদ্ধৃত একটি পদও তাহার সাক্ষ্য— 

উইঅ উরে ভুসুকু তারা৷ শান্তি ভণই পোহান্ত পহারা।।


৪৬ সংখ্যক চর্যাটীকায় ভুসুকুপাদের নামে উদ্ধৃত একটি শ্লোকও—  ভুসুকু ও শান্তিদেবের একত্ব প্রতিপাদন করে ৷  

★★বোধিচর্যাবতার-রচয়িতা শান্তিদেব সপ্তম শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন  (বিধুশেখর শাস্ত্রী)৷ ★★

শান্তিদেব ছাড়া অন্য কেউ ভুসুকু নামে পরিচিত, এমন তথ্য কোথায়ও পাওয়া যায় নি৷ 

তবু কেউ কেউ ভুসুকু ও শান্তিদেবের বাক্তিত্বকে পৃথক মনে করে প্রশ্ন তুলেছেন, ভুসুকু এত প্রাচীন কি না ? হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নিজেই বলেন, 

শান্তিদেব ও ভুসুকু যে একই ব্যক্তি তাহাতে সন্দেহ নাই।….. গানের ভুসুকু ও শান্তিদেব এক কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ। কারণ, গানগুলি সহজযানের ও পুঁথিগুলি মহাযানের।


অনুরূপ প্রতিধ্বনি সুকুমার সেনের লেখাতেও পাওয়া যায় — 

শান্তিদেব অনেক আগেকার লোক ৷ তিনি মঞ্জুশ্রীর উপাসক। আর ভুসুকু ছিলেন সহজানন্দের সাধক।


অর্থাৎ এই দুজনের একত্ব স্বীকারে বাধা দাঁড়াচ্ছে একটি, তা হলো —  একজন মহাযান মতের সমর্থক অন্যজন সহজযানের। এমতেরও কিনারা পাওয়া অসম্ভব নয়। শান্তিদেবের যে জীবন-চিত্র পাওয়া যায় তাতেই একটা অনুকূল সমর্থন পাওয়া যায়।

——————————————————————
আরো পড়ুন — কবি লুইপাদ 
—————————————————————

শান্তিদেবের (ভুসুকু?) জীবন-চিত্র


হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটির ৯৯৯০ নম্বর তালপাতার পুথি থেকে শান্তিদেবের যে জীবন-চিত্র উদ্ধার করেছেন, তা এইরূপ — 

শান্তিদেব ছিলেন রাজার ছেলে৷ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবার আগে তার মা তাকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুবজ্রের কাছে উপদেশ নিতে বলেন। শান্তিদেব ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা করলেন ৷ পথে মঞ্জুবজ্রের এক শিষ্যের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল এবং ১২ বছর তার কাছে থেকে শান্তিদেব মঞ্জু-শ্রী-মন্ত্রে সিদ্ধ হলেন ৷ এরপরে তিনি রাউত ( ‘Horse Man’) -বেশে যাত্রা করলেন মগধের উদ্দেশে ৷ মগধরাজের কাছে ‘অচল সেন’ নামে নিজের পরিচয় দিলেন। মগধরাজ অশ্বারোহী, তরবারিধারী অচলকে সৈনাপত্যে নিযুক্ত করলেন। সেখানে তরবারিকে আশ্রয় করে তার অদ্ভুত সিদ্ধি প্রকাশিত হলো। তখন তিনি রাজকার্য ত্যাগ করে ভিক্ষুবেশে নালন্দায় এলেন ৷ এইখানেই তিনি ‘শিক্ষাসমুচ্চয়’ ও ‘বোধিচর্যাবতার’ রচনা করেন ৷ ভোজনকালে, সুপ্ত অবস্থায় এবং কুটি গমনে (বিশ্রাম কালে) — সমাধি সমাপন্ন থাকতেন বলে তিনি ‘ভুসুকু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। এবং এই নামেই ‘সহজগীতি’ (চর্যাগান) রচনা করেছেন ৷ 

কাজেই যিনি শান্তিদেব, তিনিই অচল সেন, তিনিই রাউত, তিনিই ভুসুকু। যিনি মধ্যমক শূন্যবাদের প্রবক্তা, তিনিই তান্ত্রিক মঞ্জু-শ্রী-সিদ্ধ, তিনিই আবার সহজসমাধিসম্পন্ন ভুসুকু ৷ শান্তিদেব যে সময়ের তখন বিজ্ঞানবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। আর সেকারণেই তিনিই যে পরে তন্ত্রমতে তথা সহজমতে বিবর্তিত হননি সেকথা কে বলবে ?  


—————————————————————————–

★★ এখানে ভুসুকুর রচিত চর্যার [৮টি]  কাব্যমূল্য সম্বন্ধে আলোচিত হয়নি। পাঠকেরা চাইলে পাঠাতে পারেন।★★

ঋণ : জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী  

আরো পড়ুন :  প্রসঙ্গ পুথি ২য় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *