ফটিক চক্রবর্তী নামটা সকলেরই জানা মনে হচ্ছে, তাই না? হ্যা, হবেই তো। কারণ, শাহজাদপুরের এই ছেলেটি ছিল দুর্দান্ত দামাল ৷ সারাদিন কাটত তার মাঠে মাঠে ঘুড়ি উড়িয়ে, তাইরে নাইরে না গান গেয়ে, ফুলঝোর নদীতে সাঁতার কেটে। দল বেঁধে নদীর ধারে ‘মারো ঠ্যালা ইেইয়ো, সাবাস জোয়ান হেঁইয়ো’ বলে বড়ো বড়ো কাঠ গড়িয়ে ফেলার খেলা করত, মারামারি করত ৷ আবার মারামারিতে হেরে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে আধো ডোবা নৌকোর গলুয়ের উপর আপন মনে বসে থাকত। একদিন হঠাৎ মামা এসে নিয়ে গেলেন কলকাতার লেখপড়া শেখানোর জন্য ৷ মামি কিন্তু সংসারে এই বাড়তি মানুষটাকে ভালো চোখে দেখলেন না৷ শেষ পর্যন্ত অন্যত্র যা হয় এখানেও তাই ঘটল। মামির অনাদরে উত্যক্ত হয়ে ছেলেটি মামার কাছে বাড়ি যাবার আর্জি জানাল ৷
মামা বললেন–ছুটি হলে যেয়ো।
কিন্তু স্কুলের ছুটি আসার আগেই এই সংসার থেকে তার ছুটি হয়ে গেল৷ এই হলো ফটিক চক্রবর্তীর কাহিনি ৷ রবীন্দ্রনাথ এই ফটিক চক্রবর্তীর কাহিনিটিকেই নাম দিয়েছেন ‘ছুটি’।
রবীন্দ্রনাথ যখন শাহজাদপুরে থাকতেন, তখন কুঠিবাড়িতেই হোক, বোটেই হোক অথবা জলপথে ভ্রাম্যমান জীবনেই হোক, ক্যামেরার চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন বাইরের দিকে ৷ গল্প লেখার মন নিয়েই সব কিছু দেখতেন ৷ আর সুবিধে মতো গল্পে তাদের ঠাঁই দিতেন ৷ এমনি করেই শাহজাদপুরের গোপাল সাহার মেয়ে হল ‘সমাপ্তি’ গল্পের নায়িকা, পোস্টমাস্টার মহেন্দ্রলাল বন্দোপাধ্যায় হলো ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের নায়ক। চক্রবর্তীদের ছেলে হারান চক্রবর্তী হলো ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক ফটিক ৷ কলিমদ্দি বাবুর্চি স্থান পেল ‘চিরকুমার সভা’ নাটকে ৷ হাবা গোবা ঠিকা চাকর মোমিন মিঞা রবীন্দ্র কাব্যে স্থান করে নিলো ৷ এখানকার নগণ্য এবং অতি তুচ্ছ ঘটনাগুলিকেও তিনি তাঁর বিরাট সাহিত্য সংসারে ঠাঁই না দিয়ে পারেননি। কুঠিবাড়ির সামনে খালের ওপারে বিস্তৃত মাঠের উপর তাঁবু ফেলা বেদিয়াদের ঝগড়া ও ঘরকন্না, পৌষে কনকনে শীতে স্থানে অনিচ্ছুক শিশুটির উপর সারা গায়ে কাপড় জড়ানো মায়ের নিষ্ঠুর প্রহারের দাগ “ছিন্নপত্রের” পাতায় যেন প্রাণময় হয়ে আছে৷
ফটিক চক্রবর্তী হঠাৎই একদিন রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়ে গেল৷ তিনি নিজেই লিখেছেন—
সাজাদপুরজুন ১৮৯১বিকেল বেলায় আমি এখানকার গ্রামের ঘাটের উপরে বোট লাগাই। অনেকগুলো ছেলেয় মিলে খেলা করে, বসে বসে দেখি। কিন্তু আমার সঙ্গে সঙ্গে নিশিদিন যে পদাতিক সৈন্য লেগে থাকে তাদের জ্বালায় আর আমার মনে সুখ নেই। ছেলেদের খেলা তারা বেয়াদবি মনে করে……….কালও তারা ছেলেদের তাড়া করতে উদ্যত হয়েছিল, আমি আমার রাজমর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের নিবারণ করলুম। ঘটনাটা হচ্ছে এই— ডাঙার উপর একটা মস্ত নৌকোর মাস্তুল পড়ে ছিল— গোটাকতক বিবস্ত্র ক্ষুদে ছেলে মিলে অনেক বিবেচনার পর ঠাওরালে যে, যদি যথোচিত কলরব সহকারে সেইটেকে ঠেলে ঠেলে গড়ানো যেতে পারে তাহলে খুব একটা নতুন এবং আমোদজনক খেলার সৃষ্টি হয়। যেমন মনে আসা অমনি কার্যারম্ভ। ‘শাবাশ জোয়ান হেঁইয়ো! মারো ঠেলা হেঁইয়ো!’ সব কটায় মিলে চীৎকার এবং ঠেলা। মাস্তুল যেমনি এক পাক ঘুরছে অমনি সকলের আনন্দের উচ্চহাস্য।…..[ছিন্নপত্রাবলী : পত্রসংখ্যা ২৪]
এই ছেলের দলের নায়কটিই হয়েছে— ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক ফটিক চক্রবর্তী।
আরও পড়ুন : অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ
আরও পড়ুন : রবীন্দ্র জয়ন্তী ও শরৎচন্দ্র
দ্বারিয়াপুরের চক্রবর্তীদের ছেলে হারানচন্দ্রই যে “ছুটি” গল্পের ফটিক শাহজাদপুরের অনেকের তাই ধারণা ৷ কারণ কুঠিবাড়ির অদূরেই ছিল চক্রবর্তীদের বাড়ি ৷ চক্রবর্তী বাড়ির এই অপুর্ব সুন্দর ছেলেটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়েছিল ৷ তবে সে অন্য বেশে এবং অন্য পরিবেশে ৷ রবীন্দ্রনাথের শখের বাগানে ফুল চুরি করতে গিয়ে হারানচন্দ্র ধরা পড়েছিল।
কাহিনিটি এইরকম :
রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন গোলাপ গাছের দিকে। তাইতো ফুল গুলো আজও ছিঁড়ে নিয়েছে! আমার বাগানে হাত দেয়, সাহস তো বড় কম নয়। আচ্ছা দেখি তো পদ্মগুলোর কি অবস্থা। কুঠিবাড়ির দক্ষিণের বাগানে ঢুকলেন তিনি। সেখানেও বিস্ময়! গোটা দুই তিন পদ্মের নাল দাঁড়িয়ে আছে মুখ শুকনো করে। রবীন্দ্রনাথ মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেন— দুঃখ পেলেন তিনি।কবি কাউকে কিছু বললেন না। শুধু ভাবছেন মনে মনে। দারোয়ানদের কে জানাবেন না। চোর ধরতেই হবে, আর ধরবেন নিজে হাতে।সেদিনও শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে ঘুম ভাঙলো রবীন্দ্রনাথের। পুবের আকাশের আবছায়া তখনও কাটেনি। রবীন্দ্রনাথ ধীর পায়ে নেমে এলেন লোহার শিক বসানো রেলিং ঘেরা উত্তরের বাগানে। আরে, কে যেন রেলিং টপকাচ্ছে না ? তাই তো। কে একজন গোলাপ গাছে হাত দিল— এই তো চোর। রবীন্দ্রনাথ চুপি চুপি পেছনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন— কে তুমি ?চমকে উঠলো সুন্দর কিশোর— হাত থেকে পড়ে গেল ফুলের সাজি। পালাবার উপায় নেই। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ফুল চোর। মুণ্ডিত-মস্তক, গেরুয়া রঙের কাপড় পরা, কাধের উপর থেকে ঝুলে পড়েছে যজ্ঞসূত্র। রবীন্দ্রনাথ স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন এই পুষ্প চোরের দিকে। মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। কোমল করে বললেন— তুমি রোজ ফুল নাও ?বালকটি বললে— হ্যাঁ।রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন— তোমাদের বাড়িতে বিগ্রহ আছে?বালকটি বললে— হ্যাঁ, আছে।— কে পুজো করে?— কেন এখন আমি করছি তো।কোথায় গেল ক্রোধ, কোথায় গেল ক্ষোভ, কোথায় বা গেল বিরক্তি? রবীন্দ্রনাথ খুব মৃদুস্বরে বললেন ছেলেটিকে — ঠাকুর পুজোর জন্য ফুল নেবে মানা করি না। আমার অকালের পদ্মগুলোতে আর গোলাপগুলোতে যেন হাত দিও না, বুঝলে ? বালক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।কবির এই কথার মধ্যে তিরস্কারের আভাস থাকলেও তা ছিল স্নেহের মিষ্টি রসে জড়ানো।ফুলচোর এই বালকটির নাম ছিল হারান চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির অল্প দূরেই ছিল চক্রবর্তীদের বাড়ি। গল্পটি তাঁর নিজের মুখেই শোনা। অনেকের মতে চক্রবর্তীদের এই ছেলেটি ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চক্রবর্তী।[শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ : নরেশচন্দ্র চক্রবর্তী]
শাহজাদপুরের পোস্টমাস্টারকে নিয়েই যে রবীন্দ্রনাথ পোস্টমাস্টার গল্প লিখেছেন একথা তিনি কবুল করেছেন কিন্তু ফটিক চক্রবর্তী সম্বন্ধে অতি স্পষ্ট করে না লিখলেও চক্রবর্তীদের ডানপিটে ছেলে যে ছুটি গল্পের নায়ক একথা তিনি একাধিক জায়গায় বলেছেন৷ ফটিক চক্রবর্তীর বর্ণনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘বামুনের ছেলে, বছর তেরো বয়স ৷ স্ফূর্তি ও সজীবতার অবতার। কোমরে পৈতে বেঁধে সকলের আগে হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে৷ (শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ)
সাহায্য— “শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ” গ্রন্থ